এই বছর স্বামী ব্রহ্মানন্দের জন্মের সার্ধশতবর্ষ। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে বরাহনগর মঠে সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্বে তাঁর নাম ছিল রাখালচন্দ্র ঘোষ। তাঁর জন্ম ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারি শিকরা কুলীন গ্রামে। এই গ্রামটি বসিরহাট মহকুমার অন্তর্গত। তাঁর পিতা আনন্দমোহন ঘোষ ছিলেন জমিদার। রাখালচন্দ্র কলকাতায় এসে সিমলাপল্লির ট্রেনিং অ্যাকাডেমিতে যখন ভর্তি হন, তখন তাঁর বয়স বারো বছর। নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ট্রেনিং অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হওয়ার পর। পরে তিনি ব্রাহ্ম সমাজে গেছেন এবং নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার জন্য অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করেছেন। অবশ্য এই ব্যাপারে উৎসাহ পেয়েছেন নরেন্দ্রনাথের কাছে। রাখালচন্দ্র ও নরেন্দ্রনাথের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, “১৮৮৪ বা ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ, গ্রীষ্মকাল, আমাদের পড়িবার ঘরে নরেন্দ্রনাথ ও রাখাল রাত্রে পাশাপাশি শুইয়া আছে। খানিক রাত্রে দুজনের ভিতর তর্ক উঠিল। রাখাল বলিল যে, নরেন্দ্রনাথ অনেক দিন জিমনাস্টিক করা ছাড়িয়া দিয়াছে, সে এখন পিকক মার্চ বা ঊর্ধ্বপদ ভ্রমণ করিতে পারিবে না। এই তর্ক উঠিলে এক টাকা বাজি ধরা হইল। অর্ধেক রাত্রে তখন দুই জন উঠিয়া সম্মুখের দালানে জিমনাস্টিক শুরু করিল। নরেন্দ্রনাথ মালকোঁচা মারিয়া দালানটাতে ঊর্ধ্বপদ ভ্রমণ করিতে লাগিল আর রাখাল সঙ্গে সঙ্গে চলিতে লাগিল। পাশের ঘরে যাহারা শুইয়াছিল, তাহাদের ঘুম ভাঙিলে বকাবকি শুরু করিল কি উৎপেতে ছেলে, আদ্দেক রাতে উঠে জিমনাস্টিক শুরু করেছে? ছোঁড়া দুটো মাথাপাগলা, একটু বিবেচনা নেই যে, লোক ঘুমুচ্ছে।”
নরেন্দ্রনাথ দক্ষিণেশ্বরে এসেছিলেন ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে। এর আগে অবশ্য কয়েক বার রাখালচন্দ্র দক্ষিণেশ্বরে এসে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। প্রথম বার শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখে রাখালচন্দ্রের কেমন অনুভূতি হয়েছিল, সে সম্পর্কে সপার্ষদ শ্রীরামকৃষ্ণ গ্রন্থে মণি বাগচী লিখেছেন, “প্রথম দর্শনেই আমার অন্তরে বিদ্যুৎ চমকের মতো কি এক উচ্ছ্বাস খেলে গেল আমার সমস্ত দেহ-মন-প্রাণ এককালে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল, ঠিক যেমন চুম্বক লোহাকে টানে। মনে মনে ভাবলাম, ইনি কে? কে এই সৌম্য মহাপুরুষ? তাঁর প্রতি তাকিয়ে আমার মনে হয়েছিল কী যেন একটা দিব্য মাধুরী তাঁর পলকহীন দৃষ্টির সামনে খেলে বেড়াচ্ছে। ফিরে আসার সময় সারাটা পথ আমার কানে বাজছিল তাঁর সেই মধুর কথা দুটি ‘আবার এসো’।”
১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা হলে ব্রহ্মানন্দ কলকাতা শাখার সভাপতি হয়েছিলেন। পরে স্বামীজি তাঁকে মিশনের পুরো দায়িত্ব দেন ও সভাপতি করেন। মিশন প্রতিষ্ঠার আগে স্বামীজি ব্রহ্মানন্দকে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে চিঠিতে লিখেছিলেন, “যাঁর মনে সাহস, হৃদয়ে ভালবাসা আছে, সে আমার সঙ্গে আসুক। বাকি কাউকে আমি চাই না। মার কৃপায় আমি একা এক লাখ আছি, বিশ লাখ হব। আমার একটি কাজ হয়ে গেলেই আমি নিশ্চিন্ত। রাখালভায়া তুমি উদ্যোগ করে সেইটে করে দেবে মা ঠাকুরানীর জন্য একটা জায়গা। আমার টাকাকড়ি সব মজুত। খালি তুমি উঠেপড়ে লেগে একটা জমি দেখেশুনে কেনো। জমির জন্য ৩/৪ অথবা ৫ হাজার পর্যন্ত লাগে তো ক্ষতি নেই। ঘর-দ্বার এক্ষণে মাটির ভাল। একতলা কোঠার চেয়ে মাটির ঘর ভাল। ক্রমে ঘর-দ্বার ধীরে ধীরে উঠবে। যে নামে বা রকমে জমি কিনলে অনেক দিন চলবে, তাই উকিলদের পরামর্শে করবে।”
ব্রহ্মানন্দ দেশের প্রায় সব জায়গাতে গেছেন, মিশনের অনেক শাখা-কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন ত্রিবান্দ্রম আশ্রমের এবং চেন্নাইয়ে মিশনের ছাত্রাবাসের। ব্রহ্মানন্দ বলেছেন, “তোমাদের ভিতর শুনতে পাই কেহ কেহ বলে, মিশনের সব কাজগুলো সাধনের অন্তরায় রিলিফ ওয়ার্ক ইত্যাদি করলে আধ্যাত্মিক উন্নতি হয় না।... আমাদের ভাব তোমরা বুঝতে পার না। তোমাদের উচিত ভাবটা নেওয়া, অবশ্য আমি এ কথা পুনঃপুনঃ বলি এবং এখনও জোর করে বলছি যে, দুর্ভিক্ষ নিবারণ কার্য ইত্যাদি যে কাজই করতে যাও, সকাল-সন্ধ্যায় এবং কর্মের শেষে এক-এক বার ভগবানকে ডেকে নেবে, জপ-ধ্যান করবে।... স্বামীজি বলতেন, ‘ওরে, বহুজন হিতায় যদি একটা জন্ম বৃথাই গেল এরূপ মনে করিস তা গেলই বা। কত জন্ম তো এমন আলস্যে বৃথা গেছে একটা জন্ম নাহয় জগতের কল্যাণের জন্যই গেল, ভয় কি? আর ভয়ের কারণ নেই।”
ব্রহ্মানন্দের মহাসমাধি হয় ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১০ এপ্রিল সোমবার বলরাম মন্দিরে রাত পৌনে ন’টায়। আসুন, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অন্যতম প্রধান স্থপতি স্বামী ব্রহ্মানন্দের সার্ধশতবর্ষে মানুষের সেবায় তাঁর সব দানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
পঙ্কজ পাঠক। বর্ধমান
|
জাতীয় যুব দিবসকে বিশ্ব যুব দিবসে রূপান্তরিত করে স্বামীজির জন্মনগরীতে ১২ জানুয়ারি যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে একটি বিরাট উৎসব আয়োজিত হয়েছে জেনে স্বামীজির অনুরাগীরা নিশ্চয়ই আনন্দিত হয়েছিলেন। বস্তুবাদী বামপন্থার প্রতি তাত্ত্বিক নিষ্ঠার কারণেই হয়তো অধ্যাত্মসূর্য বিবেকানন্দ পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কাছে একটু দূরবর্তী ছিলেন। বর্তমান রাজ্য সরকারের স্বামীজির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে এই আগ্রহ বিবেকানন্দপ্রেমীদের প্রশংসার্হ। কিন্তু স্বামীজির জন্মোৎসবে যে সম্ভ্রম ও গাম্ভীর্য প্রত্যাশিত ছিল, তা পূর্ণ ভাবে পেলাম না আমরা। স্বামীজির সাজে নিষ্পাপ শিশুদের চমৎকার মানিয়েছিল। কিন্তু অত্যন্ত দৃষ্টিকটু লেগেছে বিবেকানন্দ রূপে অভিনেতা দেবের আবির্ভাব। কোনও চলচ্চিত্রে তিনি স্বামীজির ভূমিকায় অভিনয় করতেই পারেন। কিন্তু একেবারে স্বামীজির জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তাঁর জনপ্রিয়তাকে এ ভাবে ব্যবহার করা অত্যন্ত অসঙ্গত এবং আপত্তিকর। কারণ, যে ধরনের ছবিতে অভিনয় ও নৃত্যাদি করে সুদর্শন এই অভিনেতা জনপ্রিয়, তার সঙ্গে স্বামীজি এবং তাঁর আদর্শের ব্যবধান অসেতুসম্ভব।
বাঙালি হিসেবে অবশ্য অজস্র ধন্যবাদ দেব সেই লেখককে, ওই বিশ্ব যুব উৎসবে পঠিত শপথবাক্যটি যাঁর রচনা। বাংলা গদ্যের এক প্রধান রূপকার স্বামীজি। তাঁরই জন্মোৎসবের শপথবাক্যে এমন আশ্চর্য অর্থহীন বাংলা (যদি ১৩-০১-র আনন্দবাজার পত্রিকায় সেটি যথাযথ প্রকাশিত হয়ে থাকে) সত্যিই অভাবনীয়। ততোধিক আশ্চর্য একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের স্লোগানের ‘মা-মাটি-মানুষ’ শব্দগুচ্ছ সন্ন্যাসী-গৃহস্থ নির্বিশেষে উপস্থিত অভ্যাগতদের দিয়ে পাঠ করিয়ে নেওয়া।
পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা-১০৩ |