কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পালনিয়প্পন চিদম্বরম সিঙ্গাপুরের বিনিয়োগকারীদের সহিত এক বৈঠকে বলিলেন, ভারতে আর্থিক সংস্কারের পথে বৃহত্তম বাধার নাম রাজনৈতিক অ-স্থিতিশীলতা। কিছু কথা শুনিলেই সত্য মনে হয়। মনে হয়, সত্যই তো, দেশে যদি রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকে, কোনও বিরুদ্ধ স্বর শোনা না যায়, তবে সরকারের পক্ষে আর্থিক সংস্কারের রথ যেমন ইচ্ছা চালানো সম্ভব। অর্থমন্ত্রী যে দেশে দাঁড়াইয়া কথাটি বলিলেন, সেই সিঙ্গাপুর তাহার একটি বড় সাক্ষী। পিপলস অ্যাকশন পার্টির কার্যত বিরোধীহীন শাসনব্যবস্থায় আর্থিক সংস্কার ভারতের বহুদলীয় এবং বহুস্বরীয় গণতন্ত্রের তুলনায় ঢের সহজে সম্ভব। কিন্তু অর্থমন্ত্রী এই কথাটি বলিবার সময় সম্ভবত ভারতের সংস্কারের ইতিহাস বিস্মৃত হইয়াছিলেন। ভারতে যতখানি আর্থিক সংস্কার হইয়াছে, তাহার কোনওটির পালেই স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির হাওয়া ছিল না। ১৯৯১ সালে নরসিংহ রাও এবং মনমোহন সিংহ যখন প্রথম আর্থিক সংস্কারের পথে হাঁটেন, তখন তাঁহাদের সরকার সংখ্যালঘু ছিল। তিনি স্বয়ং ১৯৯৭ সালে যে সবুজ বাজেট পেশ করিয়াছিলেন, সেই সময়ের বাস্তবও কি তাঁহার মনে নাই? সেই তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতাও তাঁহার আর্থিক সংস্কারের পথে বাধা হয় নাই। ইউপিএ সরকারের প্রথম দফাতেও যতখানি সংস্কার হইয়াছিল, তাহা বামপন্থীদের সক্রিয় বিরোধ সত্ত্বেও হইয়াছিল। আর দ্বিতীয় দফায় তো কথাই নাই। ফলে, অন্তত ভারতের প্রেক্ষিতে আর্থিক সংস্কার এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সরলরৈখিক সমীকরণটি অর্থমন্ত্রীর বিশ্লেষণের বিপরীতমুখী। তাহা নিছক সমাপতন হইতে পারে। আবার, রাজনৈতিক অস্থিরতাই সরকারকে অর্থনীতির পথে সাহসী হইবার প্রেরণা জুগাইয়াছে, তাহাও হওয়া সম্ভব।
পালনিয়প্পন চিদম্বরম, তাঁহার দলত্যাগ এবং প্রত্যাবর্তনের ইতিহাসসহ, মূলত কংগ্রেসি। আর পাঁচ জন কংগ্রেসির ন্যায় সম্ভবত তিনিও নেহরু-গাঁধী যুগের পুনরাবির্ভাবের স্বপ্ন দেখেন। এমন এক সময়ের স্বপ্ন, যেখানে কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠতা, এবং আধিপত্য, প্রশ্নাতীত। এই নেহরু-রাজ্য ফিরিয়া আসিলেই তাঁহাদের সংস্কারের রথ গড়গড় করিয়া চলিতে আরম্ভ করিবে কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন অভিজ্ঞতা অবশ্য বলে, যত দিন কংগ্রেসের একাধিপত্য ছিল, তত দিন সংস্কার বিশেষ হয় নাই, এমনকী রাজীব গাঁধীর জমানাতেও নহে। কিন্তু এই একাধিপত্য অদূর ভবিষ্যতে ফিরিয়া আসিবার নহে। দৈব-হস্তক্ষেপ ভিন্ন জোট রাজনীতিই ভারতের ভবিষ্যৎ। সুতরাং, নেহরু-রাজ্য ফিরিলে তবেই সংস্কার হইবে, এই অজুহাত আঁকড়াইয়া বসিয়া থাকিবার কোনও অর্থ হয় না। জোট রাজনীতির বাস্তবে সংস্কারকে যথার্থ জায়গা করিয়া দেওয়ার জন্য যাহা করা বিধেয়, কংগ্রেস তাহার কোনওটাই করে নাই। ইউপিএ-র প্রধান শরিক অন্য শরিকদের সহিতই আলোচনা করে না, বিরোধীদের সহিত আলোচনার প্রশ্নই নাই। সহমত নির্মাণ করার কর্তব্যটি পালন না করিয়া কেন সহমত নাই, সেই দুঃখে নাকে কাঁদিলে চলিবে কেন? আরও একটি প্রশ্ন এক্ষণে অনিবার্য হইয়া উঠে। দ্বিতীয় দফার ইউপিএ জোট সরকার কোনটিতে বেশি ব্যর্থ: সংস্কারে, না শাসনে? অর্থমন্ত্রী এবং তাঁহার সহকর্মীরা সম্ভবত প্রথম উত্তরটিতে হাত তুলিবেন, যদিও ঠিক উত্তর দ্বিতীয়টি। না হয় বিরোধীদের বাধায় সরকার তেমন সংস্কার করিয়া উঠিতে পারে নাই, নূতন আইন তৈরি করিতে পারে নাই, কিন্তু যে নিয়মকানুন আছে, সেগুলির পালনে কোথায় বাধা ছিল? দুর্নীতি ঠেকাইতে তো সংস্কারের প্রয়োজন হয় না। রাষ্ট্রীয় সম্পদের বণ্টনের সিদ্ধান্তকে নিরপেক্ষ করিতেও সংসদে বিল পাশ করাইবার প্রয়োজন নাই। ভর্তুকির লাগাম টানিবার সিদ্ধান্ত করিবার সামর্থ্যও সরকারেরই ছিল। ইউপিএ সরকার এই কাজগুলিও করিয়া উঠিতে পারে নাই। ২০১২ সালের শেষার্ধটি ব্যতিক্রম। তৎপূর্বে তিন বৎসর রীতিমত সংশয় জাগিতেছিল, আদৌ দেশে কোনও সরকার আছে? ক্ষমতা আঁকড়াইয়া থাকাই যখন একমাত্র উদ্দেশ্য হইয়া দাঁড়ায়, তখন এই অবস্থাই হয়। অর্থমন্ত্রী যাহাই বলুন, এই ব্যাধি না সারিলে কোনও রাজনৈতিক স্থিতিই সংস্কারে গতিসঞ্চার করিতে পারিবে না। |