‘লড়াই’টা জমে গেল এ বার।
দু’পক্ষের একই হাতিয়ার কনকচূড় ধান এবং ভাল মানের নলেন গুড়।
দীর্ঘদিন ধরে এই জোড়া হাতিয়ার নিয়েই শীতের বঙ্গদেশে মোয়ার বাজার মাত করছে জয়নগর। এ বার জয়নগরের সেই একাধিপত্যে থাবা বসাতে কোমর বেঁধেছে পাশের বহড়ু। দক্ষিণ ২৪ পরগনার এই তল্লাট জুড়ে এ বার ছেয়ে গিয়েছে পোস্টার-প্ল্যাকার্ড ‘বহড়ুর মোয়া’।
কলকাতা থেকে বারুইপুর, সেখান থেকে জয়নগর ঢোকার আগেই পড়ে ছোট্ট জনপদ বহড়ু। সেখানকার কারিগররা দাবি করছেন, দীর্ঘদিন ধরে তাঁরাই কনকচূড় ধান এবং ভাল মানের নলেন গুড়ের মিশেলে মোয়া তৈরি করে আসছেন। যে মোয়ার জনক এই এলাকারই ‘যামিনীবুড়ো’। যিনি বাড়িতে এক অনুষ্ঠানে নিজের খেতের কনকচূড় ধানের খইয়ে নলেন গুড় মাখিয়ে মোয়া তৈরি করে পরিবেশন করেছিলেন। সেই মোয়া পরে জনপ্রিয় হওয়ায় তৈরির পদ্ধতি শিখে নাম কিনেছেন জয়নগরের কারিগররা। লোকে চিনেছে ‘জয়নগরের মোয়া’। অথচ, বঞ্চিত থেকে গিয়েছে বহড়ু। তার প্রতিবাদেই এ বার এত প্রচার এবং হৃতসম্মান ফিরে পাওয়ার চেষ্টা।
জয়নগরের মোয়া কারিগররা অবশ্য বহড়ুর মোয়া কারিগরদের দাবি মানতে নারাজ। তাঁদের দাবি, মোয়া দীর্ঘদিন ধরে জয়নগরেই বানানো হচ্ছে। এলাকারই নামটাই মোয়ার আগে জুড়ে গিয়েছে। তবে, বহড়ুর মোয়া নিয়ে কোনও বিরূপ মন্তব্যও তাঁরা করেননি। তাঁদের কথায়, “ওঁরা (বহড়ুর মোয়া কারিগর) ওঁদের মতো করে ব্যবসা করুক না, আপত্তির কী আছে? ওদের মোয়ারও যদি আমাদের মোয়ার মতো স্বাদ-গন্ধ হয়, তা তো ভালই।”
কী ভাবে জয়নগর-বহড়ুতে মোয়া শিল্প জমে উঠল? |
দুই এলাকার মোয়া ব্যবসায়ী ও কারিগররা এ ব্যাপারে একই তথ্য দিয়েছেন। জয়নগর-বহড়ু ছাড়াও দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলপি, কাকদ্বীপ, নামখানা এলাকায় প্রায় ৪০০ বিঘা জমিতে কনকচূড় ধানের চাষ হয়। অন্য জেলায় এই ধানের চাষ ততটা হয় না। শীতকালে সেই ধান থেকে খই তৈরি করা হয়। এখানকার নলেন গুড়ও উন্নত মানের। বড় কড়াইয়ে নলেন গুড় জ্বাল দেওয়া হয়। অল্প গরম গুড়ে কনকচূড় ধানের খই ফেলা হয়। ধীরে ধীরে খইয়ের সঙ্গে নলেন গুড় মেশানো হয়। তারপর ওই গুড়মাখা খই ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার পর ভাল ঘি ও এলাচ গুঁড়ো মাখিয়ে মোয়া বাঁধা হয়। প্রায় সাত দিন মোয়া তাজা থাকে। মুখে দিলে গলে যায়। অন্য জেলায় এই দুইয়ের মিশেল সম্ভব নয়। তাই অন্যত্র এত ভাল মানের মোয়া হয় না। সাধারণ খইয়ের মোয়া শক্ত হয়। মুখে দিয়ে গলে না। অন্যত্র এখন মোয়াতে নানা কৃত্রিম গন্ধ প্রয়োগ করা হয়। সে ক্ষেত্রে অবিকল জনগর-বহড়ুর মোয়ার গন্ধ পাওয়া গেলেও স্বাদে তা ধারে-কাছে আসে না।
ব্যবসায় প্রতিযোগিতা এসে যাওয়ায় জয়নগর এবং বহড়ু দু’জায়গাতেই এখন মোয়ার উপরে কিসমিস ও ক্ষীর দেওয়া হচ্ছে। এতে স্বাদ আরও বাড়ে বলে কারিগরদের দাবি।
গুড়ের গুণমান অনুযায়ী জয়নগর বা বহড়ুর মোয়ার দাম কেজিপ্রতি ১২০-১৬০ টাকা। জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও পরিকাঠামোর অভাবের জন্য ‘জয়নগরের মোয়া’ এখনও রাজ্যের সর্বত্র পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না বলে আক্ষেপ করেছেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা।
এক ব্যবসায়ীর কথায়, “আমাদের মোয়ার চাহিদা রয়েছে। ২০০ জন কারিগর রাতদিন পরিশ্রম করেন। কিন্তু তা সর্বত্র সরবরাহ করা সম্ভব নয়। হাতে মাত্র তিন মাস সময় পাওয়া যায়।”
ঠিক এ জায়গাটাই এ বার ধরতে চাইছে বহড়ু। ওই এলাকার ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, আর কয়েক বছরের মধ্যে ‘জয়নগরের মোয়া’র মতোই জনপ্রিয় হবে ‘বহড়ুর মোয়া’। যে জনপ্রিয়তা আগেই পাওয়া উচিত ছিল, তার জন্যই এ বার থেকে কোমর বেঁধছে বহড়ুও। সেখানেও প্রায় ২০০ জন কারিগর শীতের তিন মাস রাতদিন মোয়া তৈরি করে চলেছেন।
আশপাশের এলাকায় দু’জায়গার মোয়াই রমরমিয়ে বিকোচ্ছে। কোনটা বেশি ভাল? দুই মোয়ায় কামড় দিয়ে এক মোয়া-রসিকের ছোট্ট উত্তর ‘‘আহা, দুটোই!” |