|
|
|
|
|
|
|
মনোরঞ্জন... |
|
উত্তম পূর্ব |
তখন তিনি মোটেও মহানায়ক নন। বরং দুর্দশা কাটাতে অরূপকুমার নামেও
অভিনয় করে ফেলেছেন। সেটিও ছিল ফ্লপ। লিখছেন আশিস পাঠক |
‘‘আর ফিল্ম লাইন নয় দাদা, যথেষ্ট হয়েছে এইবার নিয়ম করে দশটা-পাঁচটা অফিস।’’
বিশ্বাস করুন আর না করুন, এ কথা উত্তমকুমার লিখেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে। প্রায় পঞ্চাশ বছর আড়ালে থাকার পরে যে লেখা প্রকাশিত হচ্ছে আজ বইমেলায়।
১৯৪৮ থেকে ১৯৫২। উত্তমকুমার যে-সাতটি ছবিতে অভিনয় করেন তার সব ক’টাই ছিল ফ্লপ। ‘দৃষ্টিদান’, ‘কামনা’, ‘মর্যাদা’, ‘ওরে যাত্রী’, ‘সহযাত্রী’, ‘নষ্টনীড়’, ‘সঞ্জীবনী’। টালিগঞ্জে তখন তিনি ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’।
ষাটের দশকে একটি ফিল্মি পত্রিকায় দু’বছর ধরে উত্তম লিখেছিলেন তাঁর সেই দুঃসময়ের নানা কাহিনি ‘হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর’।
উত্তমকুমারের একমাত্র ‘আত্মজীবনী’ হিসেবে এত দিন বাজারে ছিল ‘আমার আমি’। গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষের অনুলিখন। আর সপ্তর্ষি প্রকাশনের যে বইটি আজ প্রকাশিত হচ্ছে, সেটি উত্তমকুমারের নিজের লেখা।
পোর্ট কমিশনার্সের কেরানি অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়। টালিগঞ্জে সিনেমা জগতে এসে নায়ক হতে চাওয়া উত্তমকুমার, কেবলই ঘা খাচ্ছেন, অপদস্থ হচ্ছেন তখনকার জাঁদরেল অভিনেতা, কলাকুশলীদের কাছে। কিছুতেই পালে বাতাস লাগছে না।
সেই হতাশা থেকে তিনি লিখছেন, “আপনারা অনেক সময় লক্ষ করেছেন কি না জানি না, কিন্তু আমি লক্ষ করেছি ... সর্বমন-প্রাণ দিয়ে আপনি যা চাইছেন তা পাচ্ছেন না আর যা পাচ্ছেন তা চাইছেন না। অথচ তা থেকে বেরিয়ে আসবার যেন কোনো উপায় নেই। ঠিক যেন ছোট্ট একটা পালতোলা নৌকো বন্দী হয়েছে একটা পুকুরের মধ্যে। পালে বাতাস লাগছে না, তরতর করে ছুটে চলার শক্তি সে হারিয়ে ফেলেছে।”
ছুটে চলার পথে যে কত বিচিত্র বাধা, সিনেমা পাড়ায় এসে বেশ কয়েক বছর ধরে এ কথা প্রতি মুহূর্তে বুঝেছিলেন উত্তমকুমার।
উত্তম লিখছেন, ‘‘একদল লোক সদাসর্বদা সেটের মধ্যেই বসে থাকতেন। তাঁরা না শিল্পী না টেকনিশিয়ান।...নতুন কোনও ছেলে বা মেয়েকে স্টুডিওর মধ্যে আসতে দেখলেই তাঁরা তাঁদের সমস্ত শক্তি নিয়ে পরিচালক আর প্রযোজককে বোঝাবার চেষ্টা করতেন, নতুন ছেলে বা মেয়েটার কিছু হবে না।’’ ওঁর জীবনেও এ ঘটনার ব্যতিক্রম হয়নি।
১৯৫০ সাল। ইন্দ্রপুরী স্টুডিও। রাজেন চৌধুরীর ‘ওরে যাত্রী’র শ্যুটিং। এক ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করছেন উত্তমকুমার। রোগিণী হয়েছেন মঞ্চ ও পর্দার বিখ্যাত অভিনেত্রী প্রভা দেবী।
প্রথম সিনেই উত্তম তাঁর নাড়ি পরীক্ষা করবেন। শট নেওয়া শুরু হবে। মুখে আলো ফেলা হল। সঙ্গে সঙ্গেই একজন বলে উঠলেন, “রাজেনদা, এ কলির ভীমকে কোথা থেকে পেলেন? পায়ে পাথর বেঁধে না রাখলে ঝড় দিলে উড়ে যাবে যে!”
উত্তম লিখেছেন, “কথাটা প্রায় শাণিত ছুরির মতো আমায় বিঁধলো আমার মনের ওপর। আর একজন মন্তব্য করলেন, একেবারে নতুন আমদানি হয়েছে যে গাঁ থেকে। ... একেই নার্ভাসনেস আর উত্তেজনায় আমার আগেই হাত পা ঠাণ্ডা হতে আরম্ভ করেছিল, এ ধরনের মন্তব্য শুনে শুরু হল কাঁপুনি।’’ ভিড়ের মধ্যে থেকে মন্তব্য এল, “চেহারা দেখেই আমাদের মালুম হয়েছে। আগেই বলেছিলুম এর দ্বারা কিস্সু হবে না।”
কাজের শেষে চলল রীতিমত জেরা। ফ্লোরের লোকেরা প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন ওঁর ওপর। আর কোনও ছবিতে কাজ করেছ, না কি এই প্রথম?
উত্তম লিখছেন, ‘‘আমি বলি না আরও দুটো ছবিতে কাজ করেছি। ... আর একজন বললেন, কিন্তু মানিক, দেখে যে মনে হচ্ছে একেবারে নতুন। মার কাছে মামার বাড়ির গল্প!’’
পরের দিন ফ্লোরে উত্তম ঢুকতেই কে যেন বলে উঠলেন, “হিয়ার কামস নিউ দুর্গাদাস।... একজন সেটাকে ঠিক করে বললেন দুর্গাদাস, না, না, তার চেয়ে বরং বল, ছবি বিশ্বাস। ভবিষ্যতে ও-তো ওনারই পদ নেবে।’’ দিনের পর দিন এ ভাবেই চলত। ভেবেছিলেন, অভিনয়ই ছেড়ে দেবেন। আবার ফিরে যাবেন পোর্ট কমিশনার্স অফিসেই।
ফিরে যাননি। কিন্তু এই কঠিন সময়ে জীবনটা যে কতটা অসহনীয় হয়ে উঠেছিল কাহিনির প্রতিটি শব্দে বুঝিয়েছেন উত্তমকুমার। ‘ওরে যাত্রী’ দর্শক নেয়নি। দু’তিন সপ্তাহ চলেই বন্ধ হয়ে গেল। এর পর ‘কামনা’ও বিশ্রী রকমের ফ্লপ করল। যেখানে প্রথম নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন উত্তমকুমার। পরিচালক নবেন্দুসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘‘নায়ক সেজে আমার অভিনয় করার স্বপ্ন, স্বপ্ন হয়েই মিলিয়ে গেল। মনে হল কী আর হবে ছবি করে! নাম তো করতে পারলাম না! দর্শকের মনে রেখাপাতই যদি না করতে পারি, তাহলে আমার অভিনয় করে লাভ!’’ লিখছেন উত্তমকুমার।
অবস্থাটা তখন এমন দাঁড়িয়েছিল যে ‘উত্তমকুমার’ নামটাই কেউ ব্যবহার করতে চাইছিলেন না। এমন সময় খবর পেলেন, সরোজ মুখোপাধ্যায় নায়ক খুঁজছেন। ওঁরা প্রথমে প্রখ্যাত অভিনেতা প্রদীপকুমারকে ছবির নায়ক ঠিক করেছিলেন। কিন্তু অন্য একটা ছবির কাজে তিনি আটকে যাওয়ায়, তাঁকে তখন পাওয়া যায়নি।
উত্তম লিখছেন, “গিয়ে দেখা করলাম। বললাম আমার সব কথা। ওঁরা শুনলেন। শুনে কী ভেবে রাজিও হয়ে গেলেন আমায় নিতে। কেবল একটা শর্ত হল আমি এই ছবিতে উত্তমকুমার নামে অভিনয় করতে পারবো না। এ ছবিতে আমার নামকরণ হলো অরূপকুমার।’’ কিন্তু নাম বদলেও কাজ হল না। ছবি আবার ফ্লপ।
এ ভাবেই টানা ফ্লপ হতে হতে উত্তম প্রথম আশার আলো দেখেছিলেন নির্মল দে-র ‘বসু পরিবার’ ছবিতে। সেখানেও শুরুতে বাধা। আপ্রাণ চেষ্টা করেও প্রথমে জায়গা পাননি তিনি।
নায়কের ভূমিকায় নেওয়া হয়েছিল অন্য এক অভিনেতা। কিন্তু চিত্রনাট্য লেখা হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি অন্য শ্যুটিংয়ে ব্যস্ত থাকায় আসতে পারেননি। এদিকে ছবির কাজে দেরি হয়ে যাচ্ছে। অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছেন পরিচালক-প্রযোজক সবাই। শেষে উত্তমকুমারকে দিয়েই ছবির কাজ শুরু করলেন ওঁরা। “আমি যথাসাধ্য অভিনয় করবার চেষ্টা করলাম। ঠিকই করে ফেলেছি, যদি এ ছবিতেও দর্শকের মনোরঞ্জন না করতে পারি, তা হলে এ লাইন ছেড়ে দেবো জন্মের মতন। এই ছবিতেই আমার বোনের ভূমিকায় অভিনয় করতে আসেন বর্তমানের বিখ্যাত নায়িকা সুপ্রিয়া চৌধুরী।’’ লিখেছেন উত্তমকুমার।
প্রোজেকশন শো’র পর ‘বসু পরিবার’য়েরও সমালোচনা হয়েছিল খুব। ‘‘ছবি মোটেই সুবিধের হয়নি। পাহাড়ী, সাবিত্রী, উত্তম সকলেই লাউড অভিনয় করেছেন। এখন জনসাধারণের কানের পর্দা থাকলে হয়!’’ এমন মন্তব্য শুনে পোর্ট কমিশনার্সে সহকর্মী গোরাচাঁদবাবুকে উত্তম বলেছিলেন, আর নয়, অনেক হয়েছে, সিনেমা লাইনটাই ছেড়ে দেবেন। আবার ফিরে যাবেন দশটা-পাঁচটার অফিসে! ‘বসু পরিবার’য়ে দর্শক তাঁকে নিল। ‘দর্শক আমাকে নিয়েছেন। যত শুনি তত আনন্দ পাই। কারণে অকারণেই যেতাম সেই সমস্ত ছবি-ঘরের সামনে যেখানে বসু পরিবার দেখানো হচ্ছে। চেয়ে দেখতাম দর্শকদের ভিড়। আত্মগোপন করে শুনতাম আমার প্রশংসা। কেউ যাতে না চিনতে পারে, তার জন্যে পরতাম কালো চশমা।’ লিখছেন উত্তমকুমার।
প্রতি দিন সকালে নিয়ম করে লিখতে বসতেন। বইটির শেষে লেখা শুরুর গল্পটিও শুনিয়েছেন, ‘‘কাজের মধ্যে যখন থাকি, তখন একরকমভাবে কাটে। কিন্তু, বাড়িতে যখন থাকি, তখন কাটে অন্যভাবে। বুকের মধ্যে যেন সদাসর্বদা হু হু করে। রবিবাবুর ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়কার যেন এই মনের বেদন, কার? চৈত্র মাসের উতল হাওয়ার...? মন যেন কিছুতেই ভরতে চায় না।”
এমন সময় একদিন ইন্ডিয়া ফিল্ম ল্যাবরেটরির তাপস মজুমদার এসে বললেন, “আপনাকে নিজের কথা লিখতে হবে।’’ চমকে উঠেছিলেন উত্তম। এত দিন যে-মানুষ অন্য লোকের লেখা সংলাপ ক্যামেরার সামনে আবৃত্তি করে এলেন, তিনি এখন লিখবেন? পাঠক নেবে? পাশেই বসেছিলেন গৌরীদেবী। সব শুনে তিনি বলেছিলেন, “লেখো না কেন, মজুমদারদা যখন বলছেন।”
তখন কথাটা চাপা পড়ে গিয়েছিল। “তার পরের দিন এসে তাপসবাবু আবার আমাকে তাগাদা করেন। সেইদিন রাত্রে বসলাম কাগজ কলম নিয়ে। ... সকালবেলায় গলা সেধে ওঠবার পরই, হাতের কাছে কাগজ কলম এগিয়ে দিয়ে গৌরী বলে ‘লেখো’। লিখতে আরম্ভ করি।’’ লিখেছেন উত্তমকুমার।
হারিয়ে যেতে বসা সেই উত্তম-লিখন ফিরে আসছে আজ, বইমেলায়। ফিরে আসছে কোনও ভাবে মাটি কামড়ে থাকা উত্তমকুমারের দিনগুলি। এ বইমেলায় সেই ফিরে আসাটাই বোধ হয় সবচেয়ে উত্তম মুহূর্ত!
|
সৌজন্য: ‘হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর’, সপ্তর্ষি প্রকাশন |
|
|
|
|
|