শনিবারের নিবন্ধ
৩ পুরুষ
লাল-হলুদ-সবুজ আলোর ঘুরন্ত বিচ্ছুরণে মঞ্চে আলোআঁধারি নকশা। আধিভৌতিক সেই পরিবেশে কয়েক জন ছায়ামানুষ একটি ঘুমন্ত মেয়েকে দড়ির দোলনায় শুইয়ে দিয়ে তা ঝুলিয়ে দিয়েছে। অর্কেস্ট্রার সুরে কীসের অশনিসঙ্কেত? কী হবে ঘুমন্ত মেয়েটির দশা?
চিৎকার করতে করতে মঞ্চে জাদুকর মানেকা সরকার প্রবেশ করতেই সসম্ভ্রমে সরে যায় সেই ছায়ামানুষেরা। মহাজাতি সদনে তখন প্রহর গোনার পালা।
কী জাদু তিনি দেখাবেন দর্শকদের? গতানুগতিক? নাকি অবিশ্বাস্য কিছু? শূন্যে ঘুরছে মানেকার হাত। ‘হোকাস ফোকাস গিলি গিলি’! কোনও জাদুমন্ত্রে খুলে গেল সেই দোলনা? কী ভাবে নিমেষে কর্পূরের মতোই উধাও হয়ে গেল দোলনায় শোয়া সেই মেয়েটি? এ-ও কি সম্ভব? আর দোলনায় জায়গায়? দর্শকদের চোখের সামনে তখন শুধুই দুলছে বিশাল টানা একটা হাতপাখা।
টইটম্বুর প্রেক্ষাগৃহে হাততালির ঝড় একটিই বার্তা দিল, জে কে রোলিংয়ের হ্যারি পটারের বিশ্ব জোড়া মহাসাফল্যেও এতটুকু চিড় ধরেনি সরকার পরিবারের ইন্দ্রজালের বক্স অফিসে।
“বাবার আমল থেকেই আমাদের বক্স অফিসে সর্বদা একটিই ফুল‘হাউসফুল’”, পি সি সরকার জুনিয়রের ওষ্ঠে আত্মপ্রসাদের হাসি।
“আমরা তো বংশপরম্পরায় জাদুকর। বাবার কাছে শুনেছি আমার ঠাকুরদা ভগবানচন্দ্র এবং প্রপিতামহ দ্বারকানাথদেবও ম্যাজিক জানতেন। কিন্তু তাঁদের সময়ে সমাজে জাদুকরদের ভাল চোখে দেখা হত না। তাই কখনও তাঁরা ম্যাজিক নিয়ে হাজির হননি দর্শকদের সামনে।”
কামরূপ কামাখ্যায় গিয়ে স্থানীয় জাদুবিদ্যার সব রহস্য জেনে ফেলায় রাস্তার মাদারিদের কোপে প্রাণ হারাতে হয়েছিল সরকার পরিবারের পূর্বপুরুষ আত্মারামকে।
“ঠাকুরদা চাননি বাবা পেশাদার জাদুকর হোন। কেননা ওই পেশায় তখন ঝুঁকি ছিল। কিন্তু বাবা কারও কথা শোনেননি।”
“ভাগ্যিস শোনেননি!” শুনলে কি আর সমস্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে বিদেশের মাটিতে ভারতীয় জাদুকলার ইলিউশন এবং হস্তলাঘবের রোম্যান্টিসিজমকে রাজকীয় ভাবে তুলে ধরতে পারতেন তিনি? বাবার সাফল্যে গর্বিত জুনিয়র প্রশ্ন করেন। “বিদেশি প্রচারমাধ্যমের নজর কাড়ার জন্য প্রায় ৬৩ বছর আগে অনন্ত ঝুঁকি নিয়ে প্যারিসের রাজপথে চোখ বেঁধে সাইকেল চালিয়েছিলেন বাবা। ম্যাজিকের মতো কাজ হয়েছিল।”
বিশ্বখ্যাত বাবার সুযোগ্য সন্তান হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য তিনি নিজেও কি কম ঝুঁকি নিয়েছিলেন? ৪৩ বছর আগে বাক্সবন্দি হয়ে ঝাঁপ দিয়েছিলেন সাগরে। সফল হওয়ার পরে “বাড়ি ফিরে দেখি আমার উদ্বিগ্ন বাবা দরজার সামনে পায়চারি করছেন। আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরেছিলেন,” স্মৃতিমেদুর তিনি। আর ১৯৮০-তে মালয়েশিয়ায় বাক্সবন্দি হয়ে ঝাঁপ দিয়েছিলেন হেলিকপ্টার থেকে।
সে-দিনও বিদেশে উড়েছিল ভারতীয় ইন্দ্রজালের জয়পতাকা।
আর সাঁইবাবার সঙ্গে তার সেই টক্কর নেওয়ার কাহিনি? জুনিয়র সংযত। “কাউকে ছোট করতে এ সব করিনি। কুসংস্কারের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দিতে চেয়েছিলাম, আর কিছু নয়।”
সিনিয়র সরকারের শততম জন্মদিবস আগামী ফেব্রুয়ারিতেই। ৪৩ বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন তিনি। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সিনিয়রের দেখানো অনেক আইটেমই এখন অতীত। কিন্তু অক্ষয়-অব্যয় তাঁর সেই বিখ্যাত ‘ওয়াটার অব ইন্ডিয়া’।
কিন্তু কী আশ্চর্য! বিনোদনের নিত্য নতুন স্রোতে গা-ভাসানো আজকের জেন ওয়াই থেকে সব বয়সি দর্শক এখনও কেন সব কাজ ফেলে ছুটে আসেন রূপকথার সওদাগরের হাতসাফাই দেখতে?
গত শতকে তিনি বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন তাজমহল আর আস্ত একখানা ট্রেন অদৃশ্য করে। একুশ শতকে পিছিয়ে থাকেননি মানেকাও। ২০০৬-এ ভরা পুকুরে সাইকেল চালিয়ে তিনি দর্শকদের হতবাক করে দিয়েছিলেন।
“বলুন তো, আর কোনও বিনোদনে এমন সব চমক দেখার সুযোগ পাবেন?” মজা করেন জুনিয়র সরকার।
বাবার মতোই দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য তিনিও ফোটান নব নব কুসুম। “পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সর্বদাই আমি ‘কনটেম্পোরারি’”, দাবি জুনিয়রের।
সরকার পরিবারে বংশ পরম্পরায় এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্ম হাত পাকাচ্ছে জাদুবিদ্যায়। “বাবাকে দেখে আমি যেমন ম্যাজিক শিখেছিলাম, আমাকে দেখে দেখে ম্যাজিক শিখেছে আমার তিন মেয়ে।” ম্যাজিকের পাশাপাশি পড়াশোনাও তাঁরা চালিয়ে গিয়েছেন। বলতে পারেন, ম্যাজিক ছাড়া আমাদের কোনও অস্তিত্বই নেই”, জুনিয়র অকপট।
এখনও তিনি স্বমহিমায়। তবু মঞ্চে কেন বার বার জায়গা ছেড়ে দেন মানেকাকে? “দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য প্রতি আইটেমে বাবা পোশাক পাল্টাতেন। এখন দর্শকেরা মানেকার ম্যাজিক দেখতে চায়। তাই আমিও সরে পড়ি সময়মতো”, ইন্দ্রজাল প্রদর্শনীতে সরকার পরিবারে বড় মেয়ের সাফল্যে ভাগ বসাতে চান না জুনিয়র।
“আমি জানি, দর্শকেরা আজও বাবার ম্যাজিকই দেখতে আসেন। আমার নয়,” জুনিয়রের ‘নতুন ম্যাজিক’ মানেকার অকপট স্বীকারোক্তি। “কিন্তু ‘বাপ কা বেটি’ প্রমাণ করার জন্য নিজেকে তিল তিল করে তৈরি করেছেন মানেকা। আমেরিকা থেকে এমবিএ করে এসেছেন। “ইন্দ্রজালে কোনও অংশে পিছিয়ে নেই সরকার পরিবারের মেয়েরা।” আর শুধু মানেকাই নন, মৌবনি আর মুমতাজও তালিম নিচ্ছেন জাদুবিদ্যার বিভিন্ন দিকে, জানালেন জুনিয়র।
সরকার পরিবারের সার্থক উত্তরসূরি হয়ে ওঠার লক্ষ্যে মঞ্চে কম ঝুঁকি নিচ্ছেন না মানেকাও। বাক্সবন্দি হয়ে বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও মঞ্চে তাঁর প্রিয় আইটেম ‘দ্য স্পিরিট অব ইন্ডিয়া’।
ইন্দ্রজাল সম্পর্কে মানেকার উপলব্ধি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। “সিনেমার মতো এই ‘লাইভ শো’-তে কোনও কাট নেই, জায়গা নেই রি-টেকের। সময়ের মধ্যে নিখুুঁত ভাবে শেষ করতে হয় প্রতিটি আইটেম।” একটু এ-দিক-ও-দিক হলে? “ছন্দপতন থেকে জীবন সংশয়ও হতে পারে।”
“ইলিউশনে মানেকা অনেক এগিয়ে গিয়েছে। নাটকীয় জাদুবিদ্যার দিকে ঝোঁক মৌবনির, মুমতাজ মনোনিবেশ করেছে হস্তলাঘব বিদ্যায়।” ইন্দ্রজালের পরম্পরা রক্ষায় পরের প্রজন্মই সরকার পরিবারের আশা-ভরসা। “শুধু আমার মেয়েরা নয়, আমার ভাই প্রভাসের ছেলে পৌরুষও ম্যাজিকে ভালই হাত পাকিয়েছে।” জুনিয়র গৃহিণী জয়শ্রী ইন্দ্রজালের পাক্কা ‘খিলাড়ি’ হয়েও প্রচার থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন। সংসারের সব দায়-দায়িত্ব যে তাঁকেই সামলাতে হয়। “আমার আয়কর জমা দেওয়ার দায়িত্বও জয়শ্রীর উপরে,” হাসেন জুনিয়র।
পি সি সরকার জুনিয়রকে দিলীপকুমার বলেছিলেন, “আমাদের ছবি দেখতে দর্শকেরা একবার আসেন। আর আপনার ম্যাজিক দেখতে আসেন তিন বার। এক বার দাদুর হাত ধরে, এক বার বাবার হাত ধরে আর শেষ বার নাতির হাত ধরে।”
কী আশ্চর্য! মহাজাতি সদনেও তো তা-ই দেখা গেল! তেরোশো আসনে আগের প্রজন্মের পাশাপাশি দলে দলে বসে জিন্স-পরা আধুনিক-আধুনিকারাও।
“বলতে পারবেন, কেন আমার ছোট ভাই প্রভাস উঁচু মানের দক্ষ পাইলট হয়েও সেই পেশা অনায়াসে ছেড়ে ইন্দ্রজাল প্রদর্শনে নেমে পড়েছিল?” পি সি সরকার ইয়ং এবং তাঁর পুত্র পৌরুষ বারাসত মাতিয়ে সবে ফিরেছেন। “আসলে আমাদের রক্তেই তো ম্যাজিক। পাইলট হওয়ার পরেও দেখেছি, সবাই আমার কাছে ম্যাজিক দেখানোর আবদারই করত। আমাদের ইন্দ্রজাল সর্বদাই স্বমহিমায়। তা থাকবেও যুগ যুগ ধরে”, দূরাভাষে ভেসে এল সরকার ইয়ংয়ের কণ্ঠ।
ইন্দ্রজালের ফাঁসে দর্শকদের মোহাবিষ্ট করতে ভবিষ্যতে একটা থ্রি ডাইমেনশনাল প্রোগ্রাম তৈরি করবেন মানেকা-মৌবনি-মমতাজ ত্রয়ী। তার প্রস্তুতি চলছে, জানালেন জুনিয়র। দার্জিলিংয়ে ‘ম্যাজিক ল্যান্ড প্রজেক্ট’ বাস্তবায়িত হওয়ার পথে। খুদে পটারেরা উঠে আসবে দার্জিলিংয়ের স্কুল থেকে, তিনি আশাবাদী।
মঞ্চে যতই দাপাদাপি করুক না কেন, ম্যাজিক নিয়ে কেন কোনও রিয়্যালিটি শো হয় না টিভি-র পর্দায়? “জমবে না। ম্যাজিক তো অবাস্তবের মঞ্চরূপ। বাস্তবের মঞ্চরূপ তো নাটক।” জুনিয়রের ধারণা, ক্যামেরার সামনে ম্যাজিক দেখানো হলে ফেটে চৌচির হয়ে যাবে রূপকথার বেলুনটা। যে-কারণে সুপারফ্লপ হয়েছিল অমিতাভ বচ্চনের ‘জাদুগর’। অমিতাভ যে জাদুই দেখিয়েছেন, দর্শকেরা ধরেই নিয়েছিলেন, যে তা ক্যামেরার কারসাজি। “আমি যদি শূন্যে হাত ঘুরিয়ে পায়রা ধরি, দর্শকদেরও সেই ধারণাই হবে।”
প্রতি বছর দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও পাড়ি দিতে হয় সরকার পরিবারকে। “পর্দায় হ্যারি যতই কারিকুরি করুন না কেন, বিদেশে আমাদের চাহিদা সেই আগের মতোই”, জুনিয়রের কণ্ঠে প্রত্যয়।
বিশ্ববিখ্যাত হওয়ায় প্রশংসার পাশাপাশি যন্ত্রণার কাঁটাও তাঁকে বিদ্ধ করে। “জানেন, বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য সাপে কাটা মানুষকে নিয়ে আসা হয় আমার কাছে? ”
তাঁর ইন্দ্রজাল মঞ্চস্থ করে কখনও কোনও প্রযোজক লোকসান করেননি, দাবি করলেন জুনিয়র সরকার।
‘এক্স রে’ ম্যাজিক দেখানোর ছটায় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া এক দর্শক ব্ল্যাকবোর্ডে লিখলেন, ‘‘ইট’স স্পেক্টাকুলার’।” উত্তরে চোখবাঁধা জুনিয়র অবলীলায় লিখলেন, ‘‘দ্যাটস হোয়াই ইউ পে।”
রূপকথা চিরন্তন। তার মঞ্চরূপও। এমন কাণ্ড প্রকাশ্যে করতে পারবে রোলিংয়ের হ্যারি পটার?

ছবি: সুব্রত মণ্ডল


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.