|
|
|
|
ইন্দিরাকে বলেই গুরুর খোঁজ পাইলট-বাবার
অগ্নি রায় • ইলাহাবাদ |
পূর্বাশ্রমে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সঙ্গে টেনিস খেলার স্মৃতি তাঁর এখনও রয়েছে। ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে পারিবারিক সখ্য এবং বহু নৈশাহারের কথাও মনে থেকে গিয়েছে। ভুলতে পারেন না বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় হিংসা-রক্তপাতের দৃশ্যগুলিও।
মহাকুম্ভের বালুতটে যে ক’টি আশ্রম আয়তনে ও অভিনবত্বে চোখ ধাঁধানো, তারই একটিতে এসে পৌঁছেছি। পাইলট-বাবার আশ্রম। ভারতীয় বায়ুসেনার এই প্রাক্তন উইং কম্যান্ডার তাঁর জীবনের প্রথম পঁচিশ বছরে আধ্যাত্মিক কোনও টান অনুভব করা দূরস্থান, ছিলেন মূলত অবিশ্বাসী। যাপন করতেন বায়ুসেনার গতিময় এবং উত্তেজনাপূর্ণ জীবন। আজ উত্তর কাশীর গঙ্গোত্রীতেই শুধু নয় বিশ্বের প্রায় প্রত্যেক মহাদেশে তাঁর আশ্রম ভিড়ে-ভিড়াক্কার। ইউক্রেন থেকে অস্ট্রেলিয়া ভক্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কুম্ভমেলায় এহেন পাইলট-বাবার আশ্রমে যেন গোটা বিশ্ব বিম্বিত। গিজগিজ করছে জাপানি, রুশ, মার্কিন, ব্রিটিশ সন্ন্যাসী, শিষ্য-শিষ্যা।
শিবের পাশে রয়েছেন আবক্ষ গৌতম বুদ্ধও। তোরণ পার করে ভিতরে ঢুকতেই ডান দিকে পেল্লায় ডিভাইন হল, বাঁ দিকে পাইলট-বাবার পূর্বাশ্রমের ছবি, রোদচশমা পরা সপ্রতিভ মুখ। বর্তমান গেরুয়াধারী চেহারার দেখা মিলল পাশের মেকশিফট হল ঘরে ঢুকে। এখানে রোজ সকালে ভক্তদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। |
ভক্তদের সামনে পাইলট-বাবা।—নিজস্ব চিত্র |
“ইন্দিরাজিকে ব্যক্তিগত ভাবে জানিয়েই এক বছরের ছুটিতে চলে যাই। তারপর অবশ্য আর ফেরা হয়নি”, ভিতর থেকে ‘ডাক’ পাওয়ার কথা বলতে গিয়ে প্রায় স্বগতোক্তির স্বর পাইলট-বাবার গলায়। ভিড় টপকে তাঁর কাছে এসে বসার বিষয়টি আদৌ পছন্দ হয়নি উপস্থিত শ্বেতাঙ্গ ভক্তমণ্ডলীর। তাঁদের গূঢ় আধ্যাত্মিক অন্বেষণ চলছিল যে। অনেক ক্ষেত্রেই বাবার পায়ের কাছে বসা এক তুখোড় দোভাষীর মাধ্যমে। কেননা প্রশ্ন আসছে ফরাসি, রুশ বা স্প্যানিশে। সেই সওয়াল জবাব আপাতত স্থগিত। বাবা শোনাচ্ছেন তাঁর সন্ন্যাস নেওয়ার পিছনের এক অলৌকিক কিস্সা। “বাংলাদেশ যুদ্ধের পরই ডিব্রুগড় যাই কাজে। সেখান থেকে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে এক এয়ার স্টেশনে পৌঁছনোর কথা। মনে আছে, সারা রাত হুল্লোড়ের পর সকালে গাড়ি স্টার্ট দেব, সাফারি স্যুট পরা এক অপরিচিত সজ্জন চেহারার ব্যক্তি যেন মাটি ফুঁড়ে সামনে দাঁড়ালেন। অযাচিত ভাবেই যেতে নিষেধ করলেন। পাত্তা না দিয়ে তাঁর নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে যাই। পরিণামে মাঝ পথে দুর্ঘটনা। এর পর বহু বার আকাশপথে, স্থলপথে তাঁকে দেখেছি বিভিন্ন পোশাকে। কখনও সাক্ষাৎ মৃত্যু থেকে বাঁচিয়েছেন, কখনও সতর্ক করে দিয়েছেন। এবং কী আশ্চর্য, প্রত্যেক বারই আমার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছেন, ঠিক দু’টি টাকা!”
এই ঘটনার কথা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাকে একান্তে জানিয়েছিলেন সেই সময়কার ডাকসাইটে উইং কমান্ডার। তাঁর খোঁজে যাবেন বলেই চেয়েছিলেন ছুটি। ইন্দিরা আপত্তি করেননি, বরং কিছুটা কৌতূহলী হয়েই নাকি বলেছিলেন, মনে যখন সংশয় আসছে, তা দূর করে আসাই ভালো। বায়ুসেনাকে কার্যত বিদায় জানিয়ে জীবনটাই বদলে ফেলেছিলেন তিনি। সঞ্চিত যাবতীয় অর্থ দিয়ে দিয়েছিলেন বন্ধু দেবানন্দকে। তখন তিনি হরে রাম হরে কৃষ্ণ ছবিটি বানাচ্ছেন। ঝাড়া হাত-পা হয়ে খোঁজা শুরু করেছিলেন সেই ডিব্রুগড় থেকেই। জঙ্গলে, পাহাড়ে চলেছিল গুরু-শিষ্যের লুকোচুরি খেলা। “কী আশ্চর্য যখন চাইতাম না, তখন দেখা পেতাম। আর যখন আগ বাড়িয়ে খুঁজতে শুরু করলাম, তিনি কোথাও নেই।” তার পর তপস্যার এক দীর্ঘ যাত্রা পেরিয়ে সেই হরি বাবার দেখা পান এক জঙ্গলে, কাঠুরিয়ার বেশে। অবশেষে গুরু-শিষ্যে মিলন! বহু বছর হিমালয়ে কাটিয়ে আজ গোটা বিশ্বে ভারতীয় দর্শনের প্রচারক হয়ে উঠেছেন পাইলট-বাবা।
তাঁর প্রধান শিষ্যা জাপানি, যোগমাতা কেকো আইকাওয়া। পাইলট-বাবার সঙ্গে তাঁর ছবি আশ্রমের সর্বত্র। কেকো জানাচ্ছেন, “কোনও কৃচ্ছসাধনের পথ অথবা জটিল আধ্যাত্মিক সাধনার তন্ত্রমন্ত্র শেখান না বাবা। বরং সহজিয়া দর্শনের পথে বর্তমান ভোগবাদ এবং জীবনযন্ত্রণার জ্বালা জুড়োনোর কথা বলেন। আর তাই দেশ, সমাজ, সংস্কৃতি নির্বিশেষে সবার কাছেই তাঁর প্রবল গ্রহণযোগ্যতা।”
ভক্তদের আর অপেক্ষায় না রেখে ফিরে আসার পথ ধরি। বেরোনোর সময় এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াতে হল এক মেক্সিকান যুবতীর আর্তস্বরে। অনুবাদে যা দাঁড়াচ্ছে, “বাবা কিছুই ভাল লাগে না, নিজেকে মনে হয় সবার কাছেই অপ্রয়োজনীয়। ঈশ্বরকেও পেলাম না, এই জীবনও রাখতে ইচ্ছা করে না।” পাশ্চাত্যের ভোগবাদের সংস্কৃতিতে ক্লান্ত কণ্ঠস্বর? নাকি ব্যক্তিগত কোনও বিয়োগ অনুভূতি? সে সব বোঝার ক্ষেত্র এটা নয়।
শুধু ফিরে আসার পথে কানে বাজতে লাগল সন্ন্যাসীর মন্দ্র কন্ঠে শুদ্ধ ইংরেজিতে দেওয়া উত্তর, “নিজেকে গুরুত্ব না দিয়ে অলস হয়ে শুয়ে থাকলে, কখনওই কিছু পাবে না। নিজেকে বড় করে ভাবতে হবে। আমরা সবাই নদীর মতো, সমুদ্রে গিয়ে মেশার তাগিদটা চাই।”
নিজেরই অন্দরে ডুব দিয়ে অচেনা এক পুণ্যযাত্রার হাতছানি যেন! তা কি ছুঁয়ে গেল ওই বিদেশিনীকে? |
|
|
|
|
|