|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা ১... |
|
নয় + এক = শূন্য |
ভাল-খারাপের দ্বন্দ্ব নয়, সমস্যার কথা স্পষ্ট করে শূন্য অঙ্ক। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী |
নবম অঙ্কের পর শূন্য অঙ্কে সব গোলমাল হয়ে গেল। সাংবাদিক রাকা (কঙ্কণা সেনশর্মা) মাওবাদী-পুলিশ সংঘর্ষে ঝাঁজরা হয়ে গেল। খনি-সংস্থা যুগান্ত-র কর্তা অগ্নি বসু (প্রিয়াংশু চট্টোপাধ্যায়) বারংবার কঙ্কণার মরদেহের কাছে যেতে চাইলেও পুলিশ তাকে মেরে হঠিয়ে দিল। শপিং মল, বহুতল বাড়ির ‘ইন্ডিয়া’র সঙ্গে উপজাতি-অধ্যুষিত, অপুষ্ট গ্রামীণ ‘ভারত’-এর যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিল রাকা, আজ সে-ও মৃত। দুটো দেশ দুই পারে, মাঝে এনকাউন্টার জোন।
রাকা মৃত, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী ডাক্তার প্রবাল রায় (ধৃতিমান) আদিবাসী এলাকায় চিকিৎসাশিবির চালাতেন। কিন্তু মাওবাদীর তকমা দিয়ে পুলিশ তাঁকেও গারদে পুরে দিয়েছে। এ বার অভুক্ত, নিরন্ন নাগরিকদের প্রতি সাঁজোয়া ট্যাঙ্ক নিয়ে রাষ্ট্রের যুদ্ধ।
গৌতম ঘোষের নতুন ছবি ‘শূন্য অঙ্ক’ এমনই। ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই, প্রতিটি চরিত্রের আড়ালে লুকোনো বাস্তব কাঠামোকে পরিষ্কার চেনা যায়। রাকা আদিবাসীদের সমর্থনে। যে আদিবাসীরা মাওবাদী শিবিরে নাম লিখিয়েছে, তারা তাকে গোপন শিবিরে নিয়ে যায়। রাকা তাদের সঙ্গে থাকে, ক্যামেরায় ছবি তোলে। সর্বভারতীয় এক ইংরেজি পত্রিকায় এই ভাবেই অরুন্ধতী রায় গেরিলা শিবিরে থাকার অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন। অগ্নিকে রাকা জানায়, ‘আপনারা যাকে রেড করিডর বলেন, এখানকার আদিবাসীরা সেটাকে বলে মউ করিডর।’ তাঁর ‘ব্রোকেন রিপাবলিক’ বইয়ে একই অনুযোগ এনেছিলেন অরুন্ধতী। আদিবাসীরা যে পাহাড়কে দেবতা ভাবে, সেখানেই রয়েছে বক্সাইট আকরিক। ফলে খনি সংস্থা ‘যুগান্ত’ পুরো পাহাড়টি কিনতে চায়। অ্যালুমিনিয়াম কারখানার কারণে পরিবেশ বিনষ্ট, নদীতে লাল জল।
বাস্তবে ওড়িশায় ‘বেদান্ত’ সংস্থা এ ভাবেই বক্সাইটসমৃদ্ধ নিয়মগিরি পাহাড় কিনেছিল। স্থানীয় ডোংরিয়া কোধ উপজাতির লোকেরা সেই পাহাড়কে দেবতা ভাবলেও রেহাই মেলেনি। দূষণে লাল হয়ে গিয়েছিল ইন্দ্রাবতী নদীর জল। সিনেমার পর্দায় রাকা জেলাশাসককে জিজ্ঞেস করে, ‘শাসক দলের নেতা আগে সংস্থার নন এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর ছিলেন বলেই কি যুগান্ত গ্রুপকে এখানে বক্সাইট খোঁড়ার অনুমতি দেওয়া হল?’ এই সিনেমাটিক অনুযোগের পিছনেও বাস্তবের ছায়া। অর্থমন্ত্রী পালনপ্পিয়ান চিদম্বরম একদা বেদান্ত সংস্থার নন এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর ছিলেন। অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি প্রথম প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি দেন মরিশাসের ‘টুইনস্টার হোল্ডিংস’ সংস্থাকে। টুইনস্টার সেই অনুমতি পাওয়ার পরই বেদান্ত গ্রুপের সংস্থা স্টারলাইটের শেয়ার কেনে। এ নিয়ে সে সময় বেশ হইচই হয়েছিল। |
|
শূন্য অঙ্ক
কঙ্কণা, প্রিয়াংশু,সৌমিত্র, ধৃতিমান, প্রিয়ংকা |
অরুন্ধতীকে ফোনে পাইনি। কিন্তু রায়পুর থেকে ফোনে বিনায়ক সেন জানালেন, ছবিটা এখনও তিনি দেখেননি। এই প্রতিবেদকের থেকেই প্রথম শুনছেন। ‘আপনার মুক্তির জন্য দেওয়ার জন্য তামাম দুনিয়া আবেদন জানিয়েছিল। তার পর এখন আপনার আদলে সিনেমার চরিত্র। কেমন লাগছে?’ উত্তরে আলতো হাসছেন তিনি, ‘আমি তো জামিনে আছি।’ সুপ্রিম কোর্ট বিনায়ককে জামিনে মুক্তি দিলেও রায়পুর হাইকোর্টে এখনও মামলা ঝুলছে। আইন এই রকমই!
গৌতম ঘোষের কৃতিত্ব এখানেই। প্রকাশ ঝা-র ‘আরক্ষণ’ বা ‘রাজনীতি’র মতো ধোঁয়াটে মার্কা ছবি নয়, প্রায় ‘ডকু ফিচার’ ছবির ঢঙে প্রতিটি চরিত্রকে স্পষ্ট তুলে ধরা। কিন্তু এটি বাহ্য মাত্র। তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, ভাল বনাম খারাপ দ্বন্দ্বে না গিয়ে সমস্যাটা স্পষ্ট করে তুলে ধরা। মাওবাদ নিয়ে ‘তারা’, ‘চক্রব্যূহ’, ‘শেষ সংঘাত’ গোছের কিছু ছবি তৈরি হয়েছিল। সেখানে শুধুই ভাল বনাম খারাপের দ্বন্দ্ব। আসল সমস্যায় কেউ ঢোকেননি। ‘আদিবাসীরা কেন অস্ত্র হাতে নিল? স্বাধীনতার এত বছর পরেও তাদের পুষ্টি, শিক্ষা জুটল না কেন? কখনও ঠিকাদার আর জমিদারের হাতে শোষিত হওয়া, কখনও বড় বাঁধ আর বড় শিল্পের জন্য বাস্তুচ্যুত হওয়াই কি তাদের একমাত্র ভবিতব্য?’ শূন্য অঙ্ক এই প্রশ্নগুলিকে এক ধাক্কায় সামনে আনে। নকশালনেতা অসীম চট্টোপাধ্যায়কেও ছবির এই জায়গাটা মুগ্ধ করেছে। ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর পাল্টা সন্ত্রাসের মাঝে পড়ে আদিবাসীরা যে ভাবে প্রাণ হারাচ্ছেন, সেটা চমৎকার দেখানো হয়েছে,’ বলছেন তিনি।
সিনেমাটিক কৌশলও চমৎকার! সেরা দৃশ্য একটি পালকের উড়ান। অগ্নি তার স্ত্রী ঝিলিককে নিয়ে মানালিতে ছুটি কাটাতে গিয়েছে। বরফঘেরা মানালিতে তার জানলার নীচে একটি পালক উড়ে যায়। বাতাসে উড়তে উড়তে সেই পালক এসে পড়ে দণ্ডকারণ্যের জঙ্গলে এক আদিবাসীর ঢাকে। লঘুভার পালকই যেন ইন্ডিয়া আর ভারতকে এক তারে বেঁধে ফেলে। দুই নায়িকার মধ্যে কঙ্কণাকে আগে ‘পেজ থ্রি’ ছবিতে সাংবাদিকের চরিত্রে দেখা গিয়েছে। কিন্তু অ্যাক্টিভিস্ট-সাংবাদিকের চরিত্রে তিনি অনেক পরিণত। ঝিলিকের ভূমিকায় প্রিয়ংকা বসুর অভিনয়ও চমৎকার। বাংলা ছবি এক জন ভাল নায়িকা পেল।
ছবির অন্যতম দুর্বলতা, কবীর আর লায়লা। হুইল চেয়ারে বসা কবীর চৌধুরীর চরিত্রে সৌমিত্রের অভিনয় চমৎকার। কিন্তু চিত্রনাট্য দানা বাঁধেনি। কবীর ও তাঁর স্ত্রী লায়লা (ললিতা চট্টোপাধ্যায়) মানালিতে হোম স্টে চালান, প্রিয়াংশু ও প্রিয়ংকা সেখানে বেড়াতে যান। কবীর-লায়লার একমাত্র ছেলে বিবিসির রিপোর্টার ছিল, কাশ্মীরে নিখোঁজ। লায়লার ধারণা, মুসলমান বলে নিরাপত্তাবাহিনী তাকে মেরে ফেলেছে। কাশ্মীর থেকে দণ্ডকারণ্য সবই যে ‘হিংসায় উন্মত্ত, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব’ বোঝা গেল।
তার পর? লায়লা লেডি ম্যাকবেথের মতো হ্যালিউসিনেশনে ভোগেন, ঘরে-বাইরে রক্ত দেখে চিৎকার করেন। আর কবীর চৌধুরী বসে বসে দারা শিকো, লালন আর রবীন্দ্রনাথের কথা বলেন। কম্পিউটারে এমন হ্যাকিং সিস্টেম তৈরির চেষ্টা করেন, যা যুদ্ধবাজদের ধ্বংস করে দেবে। যে চরিত্র মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকে না, শুধুই চিত্রনাট্যকার/পরিচালকের আইডিয়ার ঢেঁকুর তোলে, তার দুর্বলতা নিয়ে সংশয় নেই।
এই দুর্বলতার কারণেই ছবিটিকে লেটার নম্বর দেওয়া গেল না। দশে সাত! কবীর আর লায়লা নাম দুটিতেই তো প্রেমের কথা আছে, সমন্বয়ের কথা আছে। এর পর হ্যাকিং করে আর যুদ্ধবাজদের ধ্বংসের আকাঙ্ক্ষা কেন? |
|
|
|
|
|