সিনেমা সমালোচনা ২...
নিছক প্রেমের কাহিনি
র্মক্ষেত্রে মহিলাদের হ্যারাসমেন্ট নিয়ে তৈরি ছবি দেখতে গিয়েছিলাম। সুধীর মিশ্র এই সংবেদনশীল বিষয়টা নিয়ে কী ভাবে কাজ করেছেন সেটা জানতেও। আর ফিরে এলাম এক অদ্ভুত প্রেমের গল্প শুনে। ‘অদ্ভুত’ বললাম কারণ এ ছাড়া আর কোনও জুতসই শব্দ খুঁজে পেলাম না।
‘ইনকার’ মায়া (চিত্রাঙ্গদা সিংহ) আর রাহুলের (অর্জুন রামপাল) প্রেমের গল্প। ওঁরা একই অ্যাড এজেন্সিতে কাজ করা দুই মধ্যবয়েসি শিক্ষিত উচ্চবিত্ত উচ্চাকাঙক্ষী মানুষ। একজন বিবাহ বিচ্ছিন্ন। অপরজন অবিবাহিত। পরিণত মস্তিষ্ক, চকচকে ঝকঝকে।
তবে এ প্রেম এক কথায় বর্ণনা করার মতো নয়। এখানে ভালবাসা আছে, কিন্তু কমিটমেন্ট নেই। শারীরিক সম্পর্ক আছে, কিন্তু বিয়ের গ্যারান্টি নেই (মায়ার মা অবশ্য আগেই সাবধান করে দিয়েছিলেন যে এ ছেলে প্রেম করবে, কিন্তু বিয়ে করবে না)। স্বার্থত্যাগ আছে কিন্তু তার জন্য ধন্যবাদ নেই। আর এই সব ফাঁকফোকর দিয়েই কখন ঢুকে পড়ে জেদ, ইগো, জেলাসি, কর্মক্ষেত্রে ওপরে ওঠার উচ্চাকাঙক্ষা আর একে অন্যকে ছোট করার চেষ্টা। যা শেষমেশ এক জায়গায় কাজ করার পরিবেশটাকেই নষ্ট করে দেয়। ‘আমাদের আইডিয়া’ ‘আমাদের কাজ’ শব্দগুলোকে বদলে দেয় ‘আমার আইডিয়া’, ‘তোমার আইডিয়া’ ‘আমার কাজ’, ‘তোমার কাজ’ ইত্যাদিতে।
ইনকার
অর্জুন রামপাল, চিত্রাঙ্গদা সিংহ, দীপ্তি নাভাল
ক্রমশই কমতে থাকে প্রেম, পারস্পরিক বোঝাপড়া। আর তখনই মায়ার প্রতি রাহুলের দৃষ্টি আর (আপাতদৃষ্টিতে) ছোটখাট ‘ফ্লার্টেশন’ ক্রমশই ‘সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট’-এর চার্জ হয়ে দাঁড়ায়। আর একই অফিসের মধ্যে এগুলো ঘটলে যা অনিবার্য, তাই হয়। সেই বিভাজনের কারণ যে খুব স্পষ্ট, তা কিন্তু নয়। ফর্মুলামাফিক মহিলা-পুরুষ আলাদা আলাদা দলবাজি নয়।
মায়ার কাছের বান্ধবী যদি মায়ার দলে হয়, তো অন্য একজন মহিলা রাহুলের দলে। তার চোখেমুখে মায়ার প্রতি মহিলাসুলভ হিংসে। আর চাকরি টিকিয়ে রাখার জন্য রাহুলের প্রতি আনুগত্য একদম স্পষ্ট। আর পুরুষেরা সবাই কোনও এক অজ্ঞাত কারণে (অথবা কারণটা সর্বজনবিদিত) তরতর করে উপরে উঠে যাওয়া মায়ার বিপক্ষেই রায় দেয়।
তখনই দরকার পড়ে এক জন নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষের। সে কাজটা করতে অফিসে আসেন দীপ্তি নাভাল। তিনি এক জন সমাজসেবী এবং এই কাজে পারদর্শী। সুতরাং আশা করা হয় তিনি একদম সঠিক, নিরপেক্ষ বিচার করবেন। কিন্তু হায়, তিনিও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। হওয়ারই কথা। তেমনই তো হয় একই ঘটনা যখন দুটো আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শোনা হয়। সত্যিমিথ্যে, উচিত, অনুচিত বিচার করা কোনও সাধারণ মানুষের কর্ম নয়। তেমনটা হলে পৃথিবীতে কোনও বিবাহবিচ্ছেদের মামলা আদালত অবধি গড়াত না। দু’জনের কমন বন্ধুবান্ধবরাই তার রায় ঘোষণা করে দিতে পারত।
কিন্তু প্রকৃত অর্থে বন্ধুরা তা পারে না। আর দীপ্তি নাভাল তো নিছকই ‘আউটসাইডার’। তিনিও পারলেন না। মায়া একবার চেষ্টা করল বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়ার। কিন্তু কিস্যু হল না। উল্টে বুঝতে পারল এই অসম লড়াই সে লড়তে পারবে না। চাকরিটাই যাবে, যে চাকরির জন্য জীবনে কত ত্যাগই না করেছে সে। এখন উপায়?
কোম্পানির বিদেশি ফিনান্সারকে বশ করার একটা শেষ চেষ্টা করল সে। যে বদনাম কেরিয়ারের শুরুর দিন থেকে পেয়ে এসেছে, কাজে উন্নতি করলে যে কোনও মহিলাই এক বাক্যে যে বদনাম পেয়ে থাকে আমাদের সমাজে। যে উপাধি দিয়ে পুরুষ কলিগরা (এবং অনেক ক্ষেত্রে সফল মহিলা কলিগরাও) এক জন মহিলার সাফল্যের এক অতি সহজ সমীকরণ খোঁজার চেষ্টা করেন, সেটাই। ঠিক সেটাই করার চেষ্টা করল মায়াপ্রথমবার, হয়তো বা শেষবারও। কিন্তু পারল কি? থাক সে কথা।
কিন্তু গল্পটা তো শেষ করতে হবে। ভালবাসা তো কবেই গিয়েছে। সম্মানও নিম্নগামী, চাকরিও প্রায় যায় যায়। তা হলে উপায়? এখানেই মদনের আবির্ভাব। না, না কোনও চরিত্রের প্রবেশ নেই। কোনও বলিউডি হিরোর বিশেষ আবির্ভাব এ ছবিতে নেই। বিশ্বাস করুন।
প্রবেশ করল ভালবাসা। পুনঃপ্রবেশ বললে বোধ হয় সঠিক বলা হয়। ওটা আসলে ছিলই। ফল্গু নদীর মতো ভিতরে ভিতরে বয়ে যাচ্ছিল। দু’জনের কেউই টের পায়নি তেমন। মায়ার বান্ধবী অবশ্য এক বার আশঙ্কা (অথবা আশা) প্রকাশ করেছিল আগেই। মায়া পাত্তা দেয়নি। দুটো মানুষ, দুটো মন, দুটো ইগো, দুটো লড়াই, দুটো কষ্ট, দুটো দুঃখ, দুটো রাগ এক জায়গায় এসে মিশে গেল আবার। আর সে কাজটা মায়াকেই করতে হল।
রাহুলের ‘মেল ইগো’ ভাঙতে হল মায়াকেই। বেশি কথার দরকার পড়েনি। শুধু ‘হোয়াই রাহুল? হোয়াই?’ ব্যস্। এইটুকুতেই বাজি জিতে নিল প্রেম। বাজি জিতে নিল গল্প। আর বাজি জিতলেন সুধীর মিশ্র। মশলা ছবির কুড়ি মিনিটের ক্লাইম্যাক্সে যেমন আগের দু’ ঘণ্টার জট ছেড়ে যায়, এখানেও ওই ‘হোয়াই’য়ের পরের দশ মিনিটে সব জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল।
এত জেদ, এত রাগ, এত ইগো সব কিছু অভিমান থেকে। যে অভিমানের জন্ম হয় প্রেম থেকে, শুধুই প্রেম থেকে, বিশ্বাস থেকে আর ভরসা থেকে।
প্রথম ভুলটা মায়াই করেছিল। ওকে যে কোম্পানির ন্যাশনাল হেড বানানো হচ্ছে, রাহুলকে জানায়নি ও সে কথা। সেই রাহুলকে, যে রাহুল ওকে ‘জাস্ট নোবডি’ থেকে আজকের ‘মায়া লুথরা’ বানাল। তো? সব কিছু বলতে হবে রাহুলকে? রাহুল বলেছে ওকে সব? মহিলা মডেলের সঙ্গে নিজের বাড়িতে অতক্ষণ সময় সে কী করছিল, জানিয়েছিল সে মায়াকে? জানায়নি। তা হলে মায়াই বা দিতে যাবে কেন সব খবর? ব্যস। সেই ইগো শুরু। আর এই ইগো শেষ। ‘হোয়াই’-এর উত্তরে।
ব্র্যাভো সুধীর মিশ্রজি। আপনাকে ব্র্যাভো বলার ধৃষ্টতা আমার দেখানো উচিত কি না জানি না। তবে একজন সাধারণ দর্শক হিসেবেই বললাম কথাটা। নিজের তৈরি কাল্ট ফিল্মের টাইটেল ‘ইস রাত কি সুবহ নেহি’, যিনি এত বছর পর আবার নিজের ছবির দৃশ্যেই কন্ডোমের বিজ্ঞাপনের ট্যাগ লাইন হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন, তাঁর সাহস, রসজ্ঞান, পরিমিতি বোধ, গল্প বলার স্টাইল, কাস্টিং, এ সব নিয়ে নতুন কী বলব?
আপনার আবিষ্কার চিত্রাঙ্গদা আপনার ছবিতে বরাবরই বড় সুন্দরী। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বরং আগের চেয়ে একটু বেশিই সুন্দরী লাগল ওঁকে। আর অর্জুন রামপাল? র্যাম্পের অর্জুন বরাবরই বড় সুন্দর। আর ‘রক অন’ পরবর্তী অর্জুন আপনার প্রযোজক প্রকাশ ঝার পরিচালনায় শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘চক্রব্যূহ’-র অর্জুনের মতোই হয়তো বা তার চেয়েও বেশি পরিণত অভিনেতা এই ছবিতে। মোহন কপূরের স্ক্রিন প্রেজেন্স বরাবরের মতোই খুব ভাল। সৌরভ শুক্ল তো আপনার ‘লাকি চামর্’। এ ছবিতে তাঁকে খুবই এক্সপেক্ট করেছিলাম, এটা সত্যি। কিন্তু ওঁকে দিয়ে কেউ একটা ‘আইটেম নম্বর’ গোছের গান গাওয়াতে (পর্দায়) পারে, এটা না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।
দীপ্তি নাভালের পর্দায় দীপ্তি আজও সমান উজ্জ্বল। তবে কানে বড় বেশি ঝোলা দুলগুলো একটু চোখে লাগছিল। গৌরব দ্বিবেদীর এই ছবিতে করার কিছুই ছিল না। তবে মায়ার কলিগ কাম একমাত্র বান্ধবীর চরিত্রাভিনেত্রী বেশ ভাল।
বহু দিন বাদে কানওয়ালজিৎ সিংহকে দেখে দারুণ লাগল। প্রত্যন্ত সাহারানপুরের এক অতি সাধারণ অফিসের হিসাবরক্ষক, ছোট্ট রাহুলের সুঠামদেহী বাবা, যাঁর চোখে অন্যায়ের কাছে নতিস্বীকার করে চাকরি বাঁচানোর চেয়ে বেশি জরুরি ছেলের কাছে নিজের সম্মানটা রাখা।
শান্তনু মৈত্র-সুধীর মিশ্র যুগলবন্দি আজ পর্যন্ত কখনও হতাশ করেনি। এ বারও না। সানন্দ কিরকিরের গলায় ‘মওলা তু মালিক হ্যায়’ এখনও কানে বাজছে। কানে বাজছে রাহুলের তোলা প্রশ্নগুলিও। মহিলারা পছন্দ করলে সেটা ফ্লার্টেশন, আর অপছন্দ করলে সেটা ‘সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট’? কী জানি, দীপ্তি নাভালের চরিত্রের মতো আমিও কেমন যেন ‘কনফিউজড’। আমার ধারণা সবাই তাই, মায় পরিচালকও। তাই গোটা ছবিতে সেই কনফিউশনটা পরতে পরতে ঢেলে দিয়েছেন তিনি। সেটা ক্লিয়ার করার কোনও চেষ্টাই করেননি।
উল্টে খুব সফল ভাবে যেটা করতে পেরেছেন, সেটা হল দর্শকদের পরিষ্কার দু’টো ভাগে ভাগ করে দিয়েছেন আমরা-ওরা, ছেলেরা-মেয়েরা। এটাই তো করতে চেয়েছিলেন।
এই জন্যই তো একই দৃশ্য বারবার দু’টো অ্যাঙ্গল থেকে শু্যট করেছেন, একই ঘটনা বারবার দু’টো দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলেছেন। একটা রাহুলের, অন্যটা মায়ার। একটা ছেলেদের, একটা মেয়েদের। আপনি কোনটা পছন্দ করবেন, কোনটা বিশ্বাস করবেন সে দায়িত্ব আপনার। ছবিটা আমার খুব ভাল লেগেছে। তবে প্রেক্ষাগৃহে খুব বেশি দর্শক দেখলাম না।
আমি দেখেছি। আপনি দেখবেন কি না, সে সিদ্ধান্ত আপনার।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.