মিলেছে চিতাবাঘের পায়ের ছাপও |
সন্ধ্যা নামলে কুকুরের ভয়ে সুনসান টুংসুং |
সন্ধে নামতে শুরু করলে গোটা এলাকা যেন শ্মশানের চেহারা নিচ্ছে। টুংসুং বাজার বন্ধ। হোটেলগুলি থেকে পর্যটকেরা বেরোচ্ছেন না। বস্তির বাড়িগুলিতে দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকে গিয়েছেন সবাই। ভুল করেও কেউ টুংসুং-এর পথে যাতায়াত করছেন না। এমনকী দিনের বেলাতেও দল বেঁধে যাতায়াত করছেন এলাকার মানুষ। প্রথমে ধারণা হয়েছিল চিতাবাঘ হানা দিচ্ছে। এখন সন্দেহ ঘুরে গিয়েছে পাহাড়ি কুকুরের দিকেও। তবে এ কাজ ব্যাঘ্রকুলের না সারমেয়র, তার উত্তর মেলেনি এখনও।
লাগোয়া পাহাড়ি বনাঞ্চল থেকে চিতাবাঘ হানা দিতে পারে বলে ভেবেছিল বন দফতর। সে জন্য খাঁচা পাতা হয়। এর পরেই বন দফতরের ধারণা কিছুটা পাল্টায়। দেখা যায়, খাঁচায় রাখা ছাগল খেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে একপাল কুকুর। এখন সেই কুকুরের পালের ভয়ে দার্জিলিং চৌরাস্তা থেকে কয়েক পা দূরের টুংসুং যেন এখন আতঙ্কনগরী। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ৪০টি কুকুরের একটি দল ঘোরাফেরা করছে ওই এলাকায়। দিনের বেলা তারা জঙ্গল, ঝোরা, কালভার্টের ভিতরে লুকিয়ে থাকছে। রাত নামতেই রাস্তার দিকে ওঁৎ পেতে থাকছে তারা। পথচলতি মানুষ বা অন্য কোনও প্রাণী দেখলেই একসঙ্গে হামলে পড়ছে তার উপর। |
টুংসুং বাজারের মুদির দোকানদার পেম্বা ভুটিয়া বলেন, “একের পর এক ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি। কুকুরের দলটি এতটা হিংস্র হয়ে উঠেছে ভাবতেই শরীর শিউরে উঠছে। সোমবার রাতে সদেব লেপাচাকে যেভাবে ক্ষতিবিক্ষত করেছে। তার পরে আর ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয়। এখন বিকেল বিকেল দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। শুধু আমি নই, গোটা বাজার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।” শুধু ব্যবসায়ীরা নন, সরকারি কর্মীরাও সন্ধ্যের আগে ফিরে যাচ্ছেন বাড়িতে। টুংসুংয়ের বাসিন্দা সরকারি কর্মী দাওয়া শেরপা বলেন, “রাতে ফিরতে সাহস হচ্ছে না। অফিসে সে কথা জানিয়েছি। তাঁরাও সন্ধ্যের আগে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। তাই করছি। ওই কুকুরগুলিকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।”
প্রশাসন সূত্রের খবর, অক্টোবরে টুংসুং থেকে এক যুবকের ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার হয়। তার পরে গত ১০ জানুয়ারি ফের টুংসুংয়ের ওই এলাকা থেকেই চেংবা শেরপা নামে একত যুবকের দেহ উদ্ধার হয়। দুটি ঘটনাতেই চিতাবাঘ হামলা করেছে বলে বন দফতর ও পুলিশের ত রফে ধারণা করা হয়। চিতাবাঘকে চিহ্নিত করতে গত রবিবার একটি ছাগলকে খাচাবন্দি করে সেখানে রেখে দেওয়া হয়। সিসিটিভি থেকে ওই খাচায় নজরদারি করে বন দফতর জানতে পারে ওই কুকুরের দলটির কথা। বন্যপ্রাণ দফতরের বিশেষজ্ঞদের ধারণা, টুংসুংয়ে একটি মাংসের বাজার রয়েছে। সেখানে অন্তত ৩০টি মাংসের দোকান রয়েছে। প্রতিদিন সেগুলির বর্জ্য ফেলা হয় টুংসুংয়ের কাছে। দীর্ঘদিন ধরে ওই কাচা মাংস ও রক্ত খেতে খেতে কুকুরগুলি হিংস্র হয়ে উঠেছে। এমনকি, খাঁচা ঢুকে ছাগল খেয়েও ধরা পড়ে দু’টি। তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। পুরসভার অফিসারেরা জানান, কুকুরদের দলনেতাকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। সেগুলি ধরে লেবং-এ পাঠানো হবে।
দার্জিলিং পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান সুখ বাহাদুর বিশ্বকর্মা কুকুরগুলিকে চিহ্নিত কের মেরে ফেলার দাবি করেছেন। তিনি বিষয়টি নিয়ে প্রশাসন ও বন দফতরের সঙ্গেও কথা বলেছেন। কিন্তু পশুপ্রেমী সংগঠনগুলির তরফে তাতে আপত্তি জানানো হয়েছে। তাদের দাবি, কুকুরগুলিকে বন্দি করে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক। দার্জিলিংয়ের অতিরিক্ত জেলাশাসক গোপাল লামা বলেন, “কুকুরগুলিকে আপাতত চিহ্নিত করে বন্দি করার কথা ভাবা হয়েছে। সে হিসেবে কাজ শুরু করা হয়েছে।” দার্জিলিং শহরের পাশে সিঞ্চল অভয়ারণ্য রয়েছে। ১৫ বর্গমাইলের এই জঙ্গলে হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ার, বুনো শুয়োর, বার্কিং ডিয়ার, চিতাবাঘ রয়েছে। বনকর্মীরা জানান, অভয়ারণ্যে ৪৫টির মত চিতাবাঘ রয়েছে। গতমাসে কাকঝোরা এলাকায় একটির দেখা মেলে। দার্জিলিং এলাকায় ১০ জানুয়ারি চেংবা শেরপার দেহের পাশে চিতাবাঘের পায়ের ছাপও মিলেছে।
|
দেখতে কেমন
খাসা চেহারা। ২৬ থেকে ৩৫ ইঞ্চি উচ্চতা। লম্বায় প্রায় ২৪ থেকে ৩৪ ইঞ্চি। তবে লেজটা দেখার মতো, ৩৫ থেকে ৪৫ ইঞ্চি, বাঁকানো ধনুকের মতো। ওজন ৭০ থেকে ৯৫ কিলোগ্রাম। সারা গা যে চাকা চাকা দাগ, এ তো ছেলেবেলা থেকে আমরা জেনে এসেছি। তবে চিতাবাঘ বা ‘প্যানথেরা পারডাস’-এর রকমফেরে অন্তত ৬ প্রজাতির রয়েছে। চিতাবাঘের মিশ কালো প্রজাতিটির নাম ব্ল্যাক প্যান্থার।
চিতা, জাগুয়ারের সঙ্গে তফাত
চিতার ঠিকানা শুধুই আফ্রিকা। অর্ধ শতাব্দী আগেও মধ্যপ্রাচ্য এমনকী ভারতেও মিলত। তবে ইওরোপ ও আমেরিকার কয়েকটি প্রান্ত ছাড়া চিতাবাঘের দেখা মেলে সর্বত্র। জাগুয়ারের ঠিকানা দক্ষিণ আমেরিকার জল-জঙ্গল (গায়ের চাকাগুলিও আকারে বড়)। সেখানে ব্ল্যাক প্যান্থারের যে প্রজাতিটি পাওয়া যায় তাদের বলে ওংকা। আমেরিকার পাহাড়ি এলাকায় চিতাবাঘেরই জাতভাই পুমা বা ক্রুগার বা মাউন্টেন লায়নের দেখা মেলে।
স্বভাব-চরিত্র
অত্যন্ত ধূর্ত। বাঘ বা সিংহ গোত্রের অন্যান্য প্রাণীর মতো দেখেশুনে, পরিস্থিতিস সমঝে আক্রণণ করা এদের ধাতে নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিনা কারনেই প্রতিপক্ষের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে আংছড়ে কামড়ে তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করে দিতে সময় নেয় কয়েক পলক। ছোটখাটো চেহারা হলেও পেশিবহুল চিতাবাঘের গায়ের জোর সাঙ্ঘাতিক। এক লহমায় ৯০ থেকে ১২০ কেজি ওজনের প্রতিপক্ষকে অনায়াতে কাবু করতে পারে সে।
খাদ্যাভ্যাস
বাসায় সদ্যজাত পক্ষী শাবক থেকে চিতল মায় সম্বরের মতো বড় মাপের হরিণকেও ঘায়েল করে তার শিকার বানায় চিতাবাঘ। অনেক সময়ে তার থাবার শিকার হয় হস্তিশাবকও। জলে নেমে তার কুমির শিকারের নজিরও রয়েছে দেদার। তবে লোকালয়ে এলে চিতাবাঘের প্রিয় খাদ্য তালিকায় প্রথমে পড়ে পথ-কুকুর। বলাই বাহুল্য মানুষ-শিকার তার কাছে বাঁ হাতের খেল।
|
১০ জানুয়ারি- চেংবা শেরপা (৩৭) নামে এক ব্যক্তির দেহ উদ্ধার। দেহটির আশপাশে চিতাবাঘের পায়ের ছাপ দেখা গিয়েছে।
২০ জানুয়ারি- একটি ছাগল রেখে সিসিটিভিতে নজরদারি। ছাগলটিকে মেরে ফেলে কুকুরের দল। দুটি কুকুর খাঁচায় আটক।
২১ জানুয়ারি- রাতে কুকুরের কামড়ে জখম সদেব লেপচা।
২২ জানুয়ারি- কুকুর পালের চিহ্নিতকরণ শুরু।
|
৪০টি কুকুরের দল রয়েছে। সেগুলি হিংস্র হয়ে উঠেছে। ৪-৫টি কুকুরের নেতৃত্বে তারা হামলা চালায় বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। সেগুলিকে সনাক্ত করে ধরার জন্য সিসিটিভি বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। বন দফতর, পুলিশ, পুরসভার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করেছি। আর কেউ যাতে আক্রান্ত না হন আমরা দেখছি।
গোপাল লামা (অতিরিক্ত জেলাশাসক)
দলটি পথচলতি মানুষের উপরে যাতে হামলা করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রেখে নজরদারি রাখা হয়েছে।
কুণাল অগ্রবাল (এসপি)
একবারই কাকঝোর এলাকায় চিতাবাঘের দেখা মিলেছে। বাকি সব ঘটনার পিছনেই কুকুরের দল রয়েছে। চিতাবাঘের জন্য টুংসুং এলাকায় দুটি খাঁচা পাতা হয়েছিল। সিসিটিভি-ও লাগানো হয়। তাতে কুকুরের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। খাঁচায় থাকা ছাগলকে কুকুরের দল বাইরে থেকেই আক্রমণ করে খুঁচিয়ে মারে। দলটি সাঙ্ঘাতিক, চিতাবাঘকেও হার মানাতে পারে।
বাসব রাজ, বনাধিকারিক (বন্যপ্রাণ-১), দার্জিলিং
প্রশাসনিক স্তরে সমস্ত বিভাগকে নিয়ে বৈঠক করা হয়েছে। সেখানে বেঙ্গল মিনিউসিপ্যাল অ্যাক্ট-১৬৮ ধারা অনুসারে পুর এলাকায় রাস্তার কুকুরকে মারা কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বৈঠকে তা অনুমোদন পায়নি। আপাতত ঠিক হয়েছে, কুকুরগুলিকে ধরে লেবং-র একটি বেসরকারি পশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হবে।
সুখবাহাদুর বিশ্বকর্মা, ভাইস চেয়ারম্যান, দার্জিলিং পুরসভা
কুকুরগুলির মধ্যে কোনগুলি নেতা তা বাছাই করে কয়েকদিন লক্ষ্য রাখতে হবে। তার পরে সেগুলি ধরে এনে খাঁচায় রাখা হবে। মাস ছয়েক ওষুধ, পরিমিত খাবার ছাড়াও কিছু প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে সেগুলি ঠিকঠাক হয়ে যাবে।
বিদ্যা তামাং, ইনচার্জ, লেবং পশু পুনর্বাসন কেন্দ্র |
|