প্রবন্ধ ২...
শতবার্ষিকী বিজ্ঞান সম্মেলন ও ভুল-ধরা বাঙালি

ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের একশো বছর পূর্ণ হল, কলকাতায়। এই শহরেই ১৯১৪ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ভারতীয় বিজ্ঞান সম্মেলনের প্রথম সূচনা করেন। স্বপ্ন ছিল নবীনদের উদ্বুদ্ধ করা। তখন বঙ্গভূমিতে নবজাগরণের প্লাবন এসেছিল, কী বিজ্ঞান, কী সাহিত্য, কী নাটক সব মিলিয়ে বাংলা তখন সৃষ্টির শিখরে। জগদীশচন্দ্র বসু রেডিয়ো তরঙ্গ তার আগেই, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে আবিষ্কার করেছিলেন। সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহা জার্মান ভাষা শিখে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের জেনারেল থিয়োরির তর্জমা করে, সাধারণ শিক্ষিত জনসাধারণের জন্য লিখেছিলেন।
সেই ১৯১৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এই ভারতীয় বিজ্ঞান সম্মেলন মোটামুটি প্রত্যেক বছরেই হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু সম্মেলনের রূপ ও ভাবমূর্তির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বিজ্ঞান সম্মেলনকে অন্য পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাঁর নিজের চেষ্টায় এই বিজ্ঞান সম্মেলন তাড়াতাড়ি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াল। সে কালে এই সম্মেলনে বিদেশ থেকে নাম করা বিজ্ঞানীদের আসার রেওয়াজ হল, নবীন বিজ্ঞানীরা এই সম্মেলনে তাঁদের বক্তব্য পেশ করার সুযোগ পেতেন, প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে পরিচয় করারও সুযোগ পেতেন।
কিন্তু ধীরে ধীরে বিজ্ঞান সম্মেলনের রূপ এক ভয়াবহ রূপে পরিবর্তিত হতে থাকল। প্রত্যেক সম্মেলনেই প্রধানমন্ত্রী নিয়মমাফিক আসেন, উদ্বোধন করেন। তিনি থাকাকালীন বহু লোক জমায়েত হয়, আবার তিনি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেশির ভাগ ডেলিগেটরা বিদায় নেয়। হল প্রায় খালি। যে সব বিজ্ঞানী বক্তব্য বলবেন, তাঁদের অবস্থা নাজেহাল। কার জন্যে এই চেষ্টা?
ব্যক্তিগত ভাবে আমার এই নাজেহাল অবস্থা বেশ কয়েক বার হয়েছে। লক্ষ করে দেখলাম যে, যাঁরা বক্তৃতা দেবেন, তাঁরা নেহাতই মামুলি বা কাঁচা, এই এক নামতা ভিন্ন সাজে সাজিয়ে যেন মানুষকে তাক লাগাচ্ছেন, এই রকম একটা ভাব। ধীরে ধীরে বিজ্ঞান সম্মেলনের মান নীচের দিকে চলতে আরম্ভ করল। অনেক নিচু মাপের বিজ্ঞানী ভারতীয় বিজ্ঞান সম্মেলনকে একটা পেশা হিসেবে গ্রাস করতে লাগলেন। অনেক রকম দুষ্টুমি করে তাঁরা ভোটে জিততে আরম্ভ করলেন। কেউ সভাপতি হলেন, কেউ সম্পাদক হলেন, ইত্যাদি। যদিও বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁদের কদর করা একেবারেই অসম্ভব।
একশো বছর পূর্তি উপলক্ষে সেই কলকাতাতেই বিজ্ঞানী সম্মেলন আবার হল। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সভাপতি, আর রাষ্ট্রপতি উদ্বোধন করলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বক্তৃতা দিলেন। বিরাট ধুমধামের সঙ্গে উদ্বোধন হল। প্রথমে ছিল সাত থেকে আট হাজার ডেলিগেট, পরে সেই নম্বর ফেঁপে-ফুলে কম করেও চোদ্দো হাজারে দাঁড়াল। বৈজ্ঞানিক বক্তৃতাগুলি অল্পবিস্তর খুব উঁচু মাপের। শুধু তাই নয়, শেষ দিন পর্যন্ত বেশির ভাগ হলই মোটামুটি ভর্তি ছিল। উঁচু মাপের বিজ্ঞান, শ্রোতার ভাল ভিড়— এই দুটোই তো আমাদের আসল লক্ষ্য। সেই পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতায় বিজ্ঞান সম্মেলন নিশ্চয় সফল হয়েছে।
আবদুল কালাম সাহেবের বাচ্চাদের জন্যে যে অধিবেশন, সেটাতে এত ভিড়, যে মানুষ অনেক কষ্ট করে ঠায় দাঁড়িয়ে কালাম সাহেবের কথা শুনছিলেন। আমাদের একটা অধিবেশন সেসান ছিল হোমি ভাবার নামে, মেগা সায়েন্সের ওপর। আমার নিজের বক্তৃতা ছিল সকাল ন’টায়। বলা যেতে পারে ভোর ন’টায়। বেশ ভয়ে-ভয়েই ছিলাম। হয়তো গোটা দশ লোক হবে। একই সঙ্গে আশ্চর্য এবং পুলকিত হলাম। বেশ ভালই লোক হয়েছিল, বিশেষ করে তরুণদের ভিড়। শেষ বক্তা ছিলেন সার্ন-এর ডিরেক্টর জেনারেল রল্ফ হয়ার। তখন মণ্ডপ গমগম করছে। যে কোনও অধিবেশনেই গিয়েছি, দেখি শ্রোতার অভাব নেই।
রবিবার, ৬ জানুয়ারি বিশ্বভারতীর উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্ত একটি মনোরম অনুষ্ঠান করেছিলেন। ‘টেগোর বোস সেশন’। কবির বিশ্বপরিচয় ব্যাখ্যা করে, গানের তালে সাহিত্য ও বিজ্ঞানের এই যোগসূত্র এ রকম ভাবে অনুভব করার সুযোগ হয়নি অনেক দিন।
দোষত্রুটি একেবারেই ছিল না, এটা বলা ভুল হবে। এক জায়গা থেকে আর একটা জায়গায় কী ভাবে যেতে হবে, সেটা হয়তো পরিষ্কার ভাবে বলা হয়নি। সমন্বয় সাধনে একটু ব্যাঘাত হয়তো ঘটেছিল, কিন্তু এই মাপের সম্মেলন ম্যানেজ করা তো চাট্টিখানি কথা নয়।
পৃথিবীর যে-কোনও বড় সম্মেলনে যোগ দিয়েছি, প্রথম দু’দিন একটু হিমশিম খেতেই হয়, তারপর সয়ে যায়। কিন্তু আমরা বাঙালিরা খুঁত খুঁজে বার করার জন্যে ভীষণ আগ্রহী। দোষারোপ করা আমাদের ধর্ম। ভাল বলতে ভীষণ কষ্ট। ছোট ছোট জিনিসকে বা ঘটনাকে আমরা আমল দিই। লোকে নাকি খেতে পায়নি। আচ্ছা, লোকে যদি একটি খাবারের কুপন থেকে চার বার বা পাঁচ বার খাবার চায় (পরিবারের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে), তা হলে খাবার কম পড়া অস্বাভাবিক কি?
বেশ কিছু বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগ দিয়েছি জীবনে। শততম সম্মেলন অসাধারণ। এই সাফল্যের জন্যে যাঁরা প্রাণপাত করেছেন, বিজ্ঞানের নানান মন্দির থেকে আমরা সবাই জানাই অভিনন্দন। যে মূল উদ্দেশ্য নিয়ে স্যর আশুতোষ বিজ্ঞান সম্মেলনের শুরু করেছিলেন একশো বছর আগে নবীনকে উদ্বুদ্ধ করা আর সেরা বিজ্ঞানীদেরকে নিয়ে আসা, কলকাতার বিজ্ঞান সম্মেলনে সেই উদ্দেশ্য ভাল ভাবেই সম্পন্ন হয়েছে নিঃসন্দেহে। এটা নিছক বিজ্ঞান সম্মেলন নয়, বিজ্ঞান উৎসব।

ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার-এর হোমি ভাবা চেয়ার অধ্যাপক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.