স্বামী কবে থেকে নেই, ‘মনে লাই’। এক মেয়ে, তারও এক মেয়ে, স্বামী একটা আছে বটে, কিন্তু না থাকারই মতো। মা যেমন চালিয়েছেন, যত দিন দেহে বল ছিল, মেয়েও তেমনই শান্তিনিকেতনের বিশিষ্টজনদের বাড়ি বাড়ি কাজ করে সংসার টানেন। মা’র ভরণপোষণের সামর্থ্য তাঁর নেই। মা শ্যামাদাসী, কখনও নিজের পদবি বলছেন মাজি, কখনও ডোম। এ নিয়ে পরে অনেক দিক্ হয়েছে, সরকারের ঘরে দু’টো নাম চলে না হয় মাজি বলো, নয় ডোম।
বাসন মেজে, কাপড় কেচে আঙুল ক্ষইয়ে ফেলা বে-দম শ্যামাদাসী আর যখন পারলেন না, তখন সম্বল হল ভিক্ষা। এক জনের পরামর্শে গেলেন পার্টি ও পঞ্চায়েতের থানে। অজন্মা কপাল যখন ঠুকতে ঠুকতে ফেটে যাবার জোগাড়, দেবতার সাড়া মিলল: নাম উঠল বার্ধক্যভাতার তালিকায়। পোস্ট অফিসে খাতা খোলা হল অনেক হ্যাপা করে। যে খাস জায়গাটাতে তাঁর ঝুপড়ি সেখান থেকে উচ্ছিন্ন করার পূর্ণ উদ্যম চলছিল। খুবই আটপৌরে অছিলা, তাঁর মেয়ের নাকি চরিত্র খারাপ। সে চেষ্টাও থামল, পার্টিদেবতার গলাখাঁকারিতে। দেশ-কাল পরিত্যক্তা নিঃশেষ-বল বৃদ্ধার আর্তি দেবতার কানে ঢোকেনি, কাজ হল শ্যামাদাসীর শুভাকাঙ্ক্ষী এক মহিলার স্বরক্ষেপে; হুকুম হল কিছু করার। সে মহিলা পার্টির কেউ নন, সদ্বংশজাতা, শিক্ষিতা, স্বাবলম্বী। |
এক জনও যে শুভার্থী আছেন, এর জোরে মাসে চারশো টাকার বার্ধক্য ভাতায় শ্যামাদাসী ভিক্ষার লজ্জা থেকে বাঁচেন। কিন্তু, কপালে ‘সুক লিকা নাই যে!’ যে মুহূর্তটাতে লোকসভায় প্রশ্নের উত্তরে জানা যাচ্ছিল, বার্ধক্য ভাতা প্রকল্পে অনেক রাজ্যের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে একশো পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, বীরভূমের এক পঞ্চায়েত অফিসে তখনই আবিষ্কৃত হল, শ্যামাদাসী বিপিএল নন। এবং, সেটা ছাড়া বার্ধক্য ভাতা পাওয়ার আইন নেই। শুভাকাঙ্ক্ষীর চেষ্টা নিষ্ফল; পার্টি দেব্তাও তত দিনে ক্ষয়রোগী, কেবলই কাশে। আর উঠতি দে-দেব্তারা হাসে।
শ্যামাদাসী বুঝতেই পারলেন না, কেন তিনি বিপিএল নন, আগেই বা তিনি কোন কানুনে ভাতা পেতেন। বিরাট দেশের বিপুল সরকারি খাত ও খাতায় যে অর্বুদ-খর্বুদ টাকার জনকল্যাণী হিসাব চলে তাতে এমন হাজার-দু’হাজার শ্যামাদাসী হারিয়ে যেতেই পারেন! তাতে তাঁর আক্ষেপ নেই; শুধু দুশ্চিন্তা: ‘আমার মে’টোরও কপালে এই আছে। লাদনিটোরও।’ |