পশ্চিমবঙ্গের স্কুলশিক্ষায় হাজার সমস্যা। কিন্তু প্রচলিত সরকারি শিক্ষার পরিসরেই ছোট ছোট
নানা উদ্যোগ চলছে, ফলও মিলছে। অনেক কিছু শেখার আছে সেই সব অভিজ্ঞতা থেকে। মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায় |
উত্তরবঙ্গ থেকে রাত্রি দুটোয় বোলপুর এসে পৌঁছেছেন মালদহের প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক জিন্নাত হোসেন। আলিপুরদুয়ার থেকে এসেছেন পদ্মা গুরুঙ্গ। ঝাড়গ্রাম থেকে ইলা পৈড়া। কর্মজীবন থেকে দু’দিনের অবকাশ নিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের বহু শিক্ষকশিক্ষিকা এসেছেন এক অভিনব গণ-আলোচনায়। এ কোনও প্রশিক্ষণ শিবির নয়, সরকারি কোনও বিশেষ শংসাপত্রও এখানে জোটে না, তবু প্রতি বছর প্রতীচী ট্রাস্টের এই আয়োজনে যোগ দিতে শিক্ষকশিক্ষিকা থেকে আরম্ভ করে শিক্ষা-গবেষক, শিক্ষা-তাত্ত্বিক, শিক্ষা-আধিকারিকরাও। রাজ্যের নানা প্রান্তে অজস্র প্রতিকূলতায় যাঁরা শিক্ষার কাজ করে চলেছেন, তাঁদের কথা শোনানোর আর শোনার সুযোগ এখানে মেলে। আসেন স্বয়ং অমর্ত্য সেনও। আসেন শুনতে, সরাসরি মানুষের মুখ থেকে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘যে মনটা আমার নিজের মধ্যে বাঁধা সেই মনটাকে অন্যের মনের সঙ্গে ভাষার যোগে মিলাইয়া দিতে পারি। কথা কওয়ার জোরে আমার মন দশজনের হয়, দশজনের মন আমার হয়। ইহাতেই মানুষ অনেকে মিলিয়া ভাবিতে পারে, তার ভাবনা বড়ো হইয়া উঠে। এই বড়ো ভাবনার ঐশ্বর্যেই মানুষের মনের গরীবিয়ানা ঘুচিয়াছে।’ (সমবায় নীতি) কথাবার্তার মাধ্যমে, আলোচনার মাধ্যমে মানুষের মনের যে প্রসার, সেই প্রসারের শক্তিই গণতন্ত্রের ভিত্তি। বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের ভার একলা বইতে গেলে কখনওই বৃহত্তর সমাজকল্যাণ সংঘটিত হয় না।
কিন্তু মত বিনিময়ের এই পরিবেশ সর্বদা সুলভ নয়। বিশেষ করে এমন পরিবেশ, যেখানে বিভিন্ন স্তরের মানুষ কোনও চাপ ছাড়াই মত ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারেন। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতাপ অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ও কর্মীর বিভাজন সেখানে প্রযুক্ত হয় না। প্রতীচী ট্রাস্ট আয়োজিত ‘বিদ্যালয় শিক্ষায় উদ্ভাবন’ সংক্রান্ত গণ-আলোচনার বার্ষিক আসর শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন অংশীদারদের সেই জায়গাটুকু করে দেয়। এ বার আলোচনা হল তথাকথিত সভাগৃহের বাইরে, গ্রামীণ পরিবেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। রাজ্যের প্রায় প্রতিটি জেলা থেকে আসা শিক্ষকশিক্ষিকা, অভিভাবক-অভিভাবিকার পাশাপাশি সেখানে ছিলেন শিক্ষা-গবেষক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধি এবং ‘সূচনা’ নামক যে সংগঠনের প্রাঙ্গণে এই আলোচনা হয়, তার ছেলেমেয়েরাও। আর ছিলেন ওড়িশা, ত্রিপুরা, হিমাচল প্রদেশ, এমনকী প্রতিবেশী বাংলাদেশেরও প্রতিনিধি। |
তথাকথিত সেমিনার স্টাইলের আলোচনা নয়, এখানে জবরদস্তি কাউকে দিয়ে ‘টু দ্য পয়েন্ট’ বক্তব্য রাখানো হয় না। দার্জিলিং জেলার হাতিঘিষা অঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা চায়না পাল স্কুলছুট ছাত্র ধরার জন্য নদীর ধারে তাঁর অভিযান প্রসঙ্গে অনায়াসে বলেন, ‘আমার স্কুলে কত যে বঁড়শি জমা হয়েছে!’ ‘টু দ্য পয়েন্ট’ হতে গেলে হয়তো বা স্কুল পালিয়ে মাছ ধরতে যাওয়া বালকের ছবিটা এমন ফুটত না। ধরা পড়ত না তাকে স্কুলমুখী করার জন্য দিদিমণির অদম্য প্রয়াস। চায়নার অভিজ্ঞতা শুনেই লালগোলার অমিত বলে ওঠেন আমবাগানে ছাত্র পড়ানোর কথা, যারা কিছুতেই ঘরে ঢুকতে চায় না। এমনি করে কথার পিঠে কথায় অঙ্ক শেখার নবীনতম পদ্ধতি যেমন পরস্পরে জেনে নিতে পারেন, তেমনই আবার মিড-ডে-মিলের হিসেব রাখার অভিনব কিছু টিপসও পেয়ে যান। আর এই ভাবেই গোটা দিন জুড়ে উঠে আসে নতুন নতুন উদ্ভাবন, হাজার প্রতিকূলতা, চোখরাঙানি, লাল ফিতের ফাঁসের মধ্যেও শিক্ষকরা যা করে যাচ্ছেন। হয়তো বা দিনের শেষে কর্তারাও চমৎকৃত হন সার্কুলার-বহির্ভূত আশ্চর্য উপায়গুলি জেনে। এই সব উদ্ভাবনী কাজকর্মের স্বীকৃতিও যেমন প্রয়োজন, তেমনই ব্যাপক প্রচার ও প্রসার দরকার। সেই সঙ্গে দরকার গুরুত্বপূর্ণ একটি সত্যকেও স্বীকার করা যে, প্রশাসনিক বিভিন্ন স্তরে, নীতিনির্ধারণে ও রূপায়ণে শিক্ষক ও অভিভাবকদের যুক্ত করা কতটা জরুরি।
বইমুখী শিক্ষকই যে শেষ কথা হতে পারে না, আলোচনাসভা তা-ও বলে। অন্য ধারার সাংবাদিক মিহির সিংহ ‘অন্যমত’ প্রবন্ধসংগ্রহে বলেছেন, ‘ছেলেমেয়েদের স্বভাবজ বা প্রকৃতিদত্ত প্রতিভাগুলোর যথাযথ বিকাশের পথে কি কোনও প্রতিষ্ঠানগত বা ব্যবস্থাগত বাধা আসছে? আমরা বড়রাই কি বাধা সৃষ্টি করছি তাদের সাহায্য করতে গিয়ে?’
প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিকে যাঁরা শিক্ষকতা করেন তাঁরা জানেন, ছাত্রছাত্রীর বিশেষ চাহিদা অনুযায়ী এদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে উপযুক্ত উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগত এবং ব্যবস্থাগত বাধা কী ধরনের। সিলেবাস শেষ করার দায় বা মূল্যায়নের একমাত্রিক পদ্ধতির প্রাধান্য তাঁদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। এরই মধ্যে বীরভূমের গোপীমোহনের মতো শিক্ষক জানালেন, কী ভাবে নিজেদের উদ্ভাবিত শিক্ষা উপকরণ দিয়ে সঠিক ভাবে গণিতের কঠিন বিষয়গুলি ছাত্রছাত্রীদের বোধগম্য করে তোলা যায়। শিক্ষকরা প্রস্তাব নিলেন, ‘প্রতিটি শিশুই আলাদা আলাদা ভাবে শিক্ষা অর্জনের ক্ষমতা আছে এটা মেনে নিলে সমস্যাগুলো সহজ হয়ে যায়।’
বক্তৃতা করাতেই যাঁরা অভ্যস্ত, প্রতীচী গণ-আলোচনায় তাঁরা নিবিষ্ট শ্রোতার ভূমিকায়। অবশ্যই তাঁদের সংযোজন গোটা পরিসরকে সমৃদ্ধ করে। দেবী চ্যাটার্জি, দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, অচিন চক্রবর্তীর মতো জ্ঞানতাত্ত্বিকদের সঙ্গে গ্রামের পোড় খাওয়া শিক্ষকশিক্ষিকাদের অভিজ্ঞতার সমন্বয় বিপুল সম্ভাবনায় পূর্ণ। বাংলার বাইরের অভিজ্ঞতার সঙ্গে বিনিময়ও গুরুত্বপূর্ণ। হিমাচলের কর্মী রাণা বসু, ত্রিপুরার আধিকারিক বনমালী সিন্হা, ওড়িশার কর্মী অনুকূল নায়েক, বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ রাহমান চৌধুরী নিয়ে গেলেন যেমন অনেক কিছু, তেমনই দিয়েও গেলেন তাঁদের অভিজ্ঞতার নির্যাস।
ইতস্তত বিক্ষিপ্ত আদর্শ বিদ্যালয়ের নমুনার অভাব নেই। বেশ কিছু নিবেদিতপ্রাণ মানুষ গতানুগতিক ব্যবস্থার বিপরীতে লড়াই করে এই প্রতিষ্ঠানগুলো গড়েছেন। মুশকিল হল, প্রধানত সামাজিক কাঠামোর কল্যাণে সেগুলির প্রতিরূপ খুব বেশি দেখা যায় না। কিন্তু সর্বজনীন ব্যবস্থাতেও ছোট ছোট চেষ্টা, সরকারি কাঠামোর মধ্যেই নানান উদ্ভাবন অবিরত চলে। এগুলোর স্বীকৃতি ও প্রসারের মধ্য দিয়েই কিন্তু আমরা ব্যবস্থাটাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে পারি; এর জন্য চাই সরকারি সদিচ্ছা ও উদ্যোগ।
কথাগুলো হয়তো নতুন নয়, কিন্তু তাতে তার গুরুত্ব কমে না। অমর্ত্য সেন এই সভায় বললেন: ‘অনেকেই বলে থাকেন, আমি নাকি নতুন কথা কিছু বলি না একই কথা বার বার বলে যাই। আমার বক্তব্য, যদি কারও টিবি হয়ে থাকে, এবং তাঁকে চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া সত্ত্বেও তিনি সেটা করান না, তখন তাঁর দাবি অনুযায়ী তাঁকে কবিতা পড়ে শোনানো চলে না তাঁকে চিকিৎসার কথাই বলতে হয়।’ স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থায় যে টিবি রোগের বাসা, সে সম্পর্কে বারংবার একত্রে কথা বলার প্রক্রিয়াটিও এক ধরনের চিকিৎসা হয়তো ধীরগতি, সময়সাপেক্ষ, কিন্তু কার্যকর।
|