আলজিরিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস ক্ষেত্রে জঙ্গি হামলায় পণবন্দি কর্মীদের মুক্তির প্রয়াস সমূহ রক্তক্ষয়ের মধ্য দিয়া সাঙ্গ হইয়াছে। মাত্র জনা ত্রিশেক জঙ্গি তিন-চার দিন ধরিয়া তৈলক্ষেত্রটিতে চড়াও হইয়া ব্রিটেন, জাপান, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের বন্দি করিয়া রাখে। মুক্তিপণ হিসাবে তাহাদের দাবি ছিল, প্রতিবেশী রাষ্ট্র মালিতে ইসলামি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ফরাসি সরকারের সামরিক অভিযান বন্ধ করা এবং মার্কিন মুলুকে বন্দি দুই আল-কায়দা জঙ্গির মুক্তি। দাবিগুলি শিরোধার্য হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। আলজিরীয় সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ চালায়। কিন্তু ত্রিশ জন জঙ্গিকে মারিয়া ফেলিলেও পণবন্দি বিদেশি নাগরিকদের এক বড় অংশকে রক্ষা করিতে তাহারা সমর্থ হয় নাই। মোট ১০৭ জন বিদেশি এবং ছয় শতাধিক আলজিরীয় কর্মী ও ইঞ্জিনিয়ারদের উদ্ধার করা গেলেও বেশ কিছু ব্রিটিশ, জাপানি ও ফিলিপিনো নাগরিকের মৃত্যু হইয়াছে।
ঘটনাটি দুর্ভাগ্যজনক। এমন নয় যে, আলজিরিয়ায় ইসলামপন্থীরা সহসা মাথা-চাড়া দিল। সামরিক জুন্টা দেশ শাসন করিলেও জনসমাজে ইসলামপন্থীদের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা যথেষ্ট। নির্বাচনেও তাহারাই জয়ী হইয়াছিল। কিন্তু সামরিক বাহিনী সেই নির্বাচনের ফলাফল মানে নাই, শাসনক্ষমতার রাশ বলপূর্বক কাড়িয়া নিজেদের হাতে রাখিয়াছে। কিন্তু তাহাতে আলজিরীয় সমাজ সেকুলার হইয়া যায় নাই। মালিতে যখন ইসলামপন্থীদের দখল হইতে দেশের উত্তরাংশকে মুক্ত করিতে ফরাসি বায়ুসেনা বোমাবর্ষণ শুরু করে, তখনই আলজিরিয়ার ইসলামিরা প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্ষেত্রে হানা দেয় এবং ব্রিটিশ, মার্কিন, জাপানি ও ফিলিপিনো কর্মচারীদের পণবন্দি করে। ঘটনাটি অতএব বিচ্ছিন্ন নয়। ইতিপূর্বে আরব বসন্তের কুলার বাতাস তিউনিসিয়া, মিশর, লিবিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের অপেক্ষাকৃত সেকুলার স্বৈরাচারীদের বিদায় করার পর উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য দেশেও যে রাজনৈতিক ইসলাম মাথা-চাড়া দিবে এবং স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের পথ না পাইলে প্রায়শ আল-কায়দার মতো জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের হাত ধরিয়াই গা-ঝাড়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইবে, তাহাও অস্বাভাবিক নয়।
মিশর বা তিউনিসিয়ায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়াই ইসলামিরা ক্ষমতাসীন হইয়াছে। লিবিয়ায় গণতন্ত্রের প্রক্রিয়ায় মাঝপথে অন্তর্ঘাত ঘটাইয়া জনজাতীয় মরুচর গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা ক্ষমতা লইয়া খেয়োখেয়ি করিতেছে। সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট আসাদ-পরবর্তী সময়ে হয়তো অনুরূপ অরাজকতাই দেখা দিবে। আর যে সব দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়া জমানা-বদলের সম্ভাবনা নাই, সেই আলজিরিয়া কিংবা মালি-তে পশ্চিম-প্রভাবিত সেকুলার সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে সঞ্চিত জনরোষ আল-কায়দার মতো জঙ্গি জেহাদিদের আস্ফালনের মধ্য দিয়াই আত্মপ্রকাশ করিবে। তবে একটি ঘটনা এই দেশগুলির প্রতিটিতেই ঘটিবে। লিবিয়াই হউক আর আলজিরিয়াই হউক, পশ্চিমি নাগরিকরা আর এ সব দেশে নিরাপদ নির্ভাবনায় থাকিতে পারিবেন না। |