ইউ পি এ সরকারের প্রথম দুই দফায় গৃহদেবতার নাম ছিল আম আদমি। তাহার নামে আচমন না করিয়া কর্তারা মুখ খুলেন নাই। তাঁহারা ২০০৪ সালে বিজেপি-র পরাজয় দেখিয়া শিখিয়াছিলেন, ভারতের উদয় লইয়া বেশি কলরব করিতে নাই, তাহাতে গণদেবতা অসন্তুষ্ট হন। জয়পুরের চিন্তন শিবিরে সিদ্ধান্ত হইল, কেবল আম আদমি নহে, কংগ্রেস মধ্যবিত্ত শ্রেণির কথা বিশেষ করিয়া ভাবিবে। ঘোষণাটি শুনিয়া আমদাবাদে নরেন্দ্র দামোদারদাস মোদী নিশ্চয়ই ঈষৎ হাসিয়াছেন। নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে অস্বীকার করিয়া যে আর একুশ শতকের রাজনীতি সম্ভব নহে, এই কথাটি তিনি কংগ্রেসের পূর্বে বুঝিয়াছিলেন। গুজরাতের বিধানসভা নির্বাচনে নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির মন জয় তাঁহার বিশেষ অভীষ্ট ছিল। কংগ্রেস তাঁহার অনুগামী হইল, এবং অনুগমনের রাজনৈতিক হীনতা মুছিয়া ফেলিবার কোনও উপায় একশত আঠাশ বৎসর প্রাচীন এই দলটির নাই। জয়পুরে সিদ্ধান্ত হইয়াছে, কংগ্রেস তরুণ প্রজন্মের সংকট বুঝিবার চেষ্টা করিবে, তাহাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার শরিক হইবে। ফেসবুক, টুইটারের ন্যায় সোশাল ম়িডিয়াতেও হাত পাকাইবার চেষ্টা করা হইবে। প্রতিটি সিদ্ধান্তেই নরেন্দ্র মোদীর ছাপ অতি স্পষ্ট। তবে, ইহাই একুশ শতকের রাজনীতির পথ। সব দলকেই এই পথে হাঁটিতে হইবে। নরেন্দ্র মোদী অন্যদের পূর্বে হাঁটিয়া লইয়াছেন, এই যা। জয়পুরের আরও একটি সিদ্ধান্ত, কিঞ্চিৎ পরোক্ষ ভাবে, তরুণ ভারতের সহিত সংযোগ বাড়াইবার কথা বলিতেছে। কংগ্রেস লিঙ্গসচেতন রাজনীতির পথে হাঁটিবার অঙ্গীকার করিয়াছে। লিঙ্গ সচেতনতার দাবি, লিঙ্গ পরিচয়ের রাজনীতির দাবি মূলত শহুরে, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত যুবসমাজেরই দাবি। এই দাবি মানিয়া লওয়ার অর্থ, কংগ্রেস আরও এক ভাবে এই শ্রেণির কাছে আসিবার চেষ্টা করিতেছে। বস্তুত, তরুণ প্রজন্মের সহিত সংযোগ গড়িয়া তুলিবার এই একটি রাস্তাই এখনও অচর্চিত আছে, নরেন্দ্র মোদী এখনও এই পথে হাঁটেন নাই। কংগ্রেসের পক্ষে ইহা বড় সুযোগ।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির গুরুত্ব রাজনীতিকরা চিরকালই বুঝিতেন। কিন্তু তাহাদের তোষণ করা হইত আড়ালে-আবডালে। যেমন, এলপিজি-র ভর্তুকি বজায় রাখিয়া। প্রকাশ্যে যাহাদের কথা বলার নিয়ম, তাহাদের অনেক নাম: কেহ তাহাদের আম আদমি বলিয়া ডাকেন, কেহ বলেন সর্বহারা, কেহ আবার মা-মাটি-মানুষ। এই শ্রেণিটির রাজনৈতিক গুরুত্বের একটি আর্থ-ঐতিহাসিক কারণ আছে। যত দিন বিশ্বায়ন আসিয়া ভারতীয় অর্থনীতির বন্ধ ঘর ওলটপালট করিয়া দেয় নাই, তত দিন মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে সচল ছিল না। যাহার যে শ্রেণিতে জন্ম, পুরুষানুক্রমে সেই শ্রেণিতেই থাকিয়া যাওয়া নিয়তি ছিল। ফলে, অর্থনৈতিক পিরামিডের একেবারে তলায় যে বিপুল সংখ্যক মানুষের বাস ছিল, তাহারা বংশানুক্রমে নিচুতলার বাসিন্দা। পিরামিডের ক্ষীণ কটিদেশে যে মধ্যবিত্ত বাস করিত, তাহারাও সেই ঠিকানারই স্থায়ী বাসিন্দা। ফলে, বড় ভোটের জন্য আম আদমি নির্বিকল্প ছিল। সব দলের সব নেতাই তাই আম আদমির মসিহা রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করিতে ব্যাকুল ছিলেন।
বিশ্বায়নের দ্বিতীয় দশক ভারতের এই ছবিটিকে বহু মাত্রায় বদলাইয়া দিয়াছে। একুশ শতকের ভারত সুযোগ চিনিতে শিখিয়াছে। বুঝিয়াছে, আর্থিক সচলতা আর ভাগ্যের হাতে নহে, চেষ্টা করিলেই নিম্নবিত্ত হইতে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে প্রবেশ করা সম্ভব। ভারতের শহরে-শহরে এই বিপ্লব চলিতেছে। এবং, এই বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি যুবসমাজ। তাহারাই শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সংখ্যায় বাড়াইয়া চলিতেছে। ব্যালট বাক্সের নিরিখে তাহাদের সংখ্যা আছে, ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে তাহাদের গুরুত্ব ক্রমবর্ধমান। বস্তুত, ২০০৪ সালে বিজেপি-র ‘ভারত উদয়’ প্রচারটির সহিত বর্তমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির গুরুত্ববৃদ্ধির মূল ফারাক হইল, ২০০৪ সালে ভারতের সমৃদ্ধি মূলত উঁচু তলায় আটকাইয়া ছিল, এখন তাহা সত্যই পিরামিডের প্রান্তে পৌঁছাইয়াছে। ভাবিলে, তাহাতে কংগ্রেসের কৃতিত্ব অস্বীকার করিবার নহে। প্রশ্ন হইল, জয়পুরে যে বোধোদয় হইয়াছে, আকবর রোডের প্রাত্যহিকতায় তাহা বজায় থাকিবে তো? |