কেউ আসেন কাশিমবাজার থেকে। কারও বাড়ি মধুপুর ও সৈয়দাবাদ এলাকায়। কেউ আবার ভাগীরথীর সেতু পেরিয়েও আসেন। শীতের আঁধার নামলেই ব্যারাক স্কোয়ার ময়দানে ব্যাডমিন্টন বা ভলিবলের আসর বসছে। দিনে চলছে ক্রিকেট।
কিন্তু পাড়ার মাঠ ছেড়ে ব্যারাক স্কোয়ারে কেন? যাঁরা খেলতে আসেন, তাঁদের কথায়ফ্ল্যাট-সংস্কৃতির চাপে উধাও পাড়ার খেলা সংস্কৃতি! কোর্ট তৈরির মত ফাঁকা মাঠ এখন অনেক পাড়ায় নেই। আর আগে যেখানে রাতে আলোর নিচে খেলার জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে পাড়া-প্রতিবেশীরাই এগিয়ে আসতেন, এখন চেয়েও পাওয়া যায় না।
এই অবস্থায় ভরসা ব্যারাক স্কোয়ারই। কেননা, ওই ময়দানের চার কোণে ৮ হাজার ওয়াট করে চারটি এইচএমএল (হাই মাস্ট লাইট) মহালয়ার দিন উদ্বোধন করার ফলে যেমন ময়দানের অন্ধকার ঘুচেছে, তেমনি পুরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডের ক্রীড়াপ্রেমী পুর-নাগরিকদের ভিড়ও বেড়েছে। সাংসদ অধীর চৌধুরী বলেন, “পুরসভার ২৫টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন পাড়ার লোকজন ভিড় করায় ঐতিহ্যপূর্ণ ওই ময়দান এখন মিনি পুর-এলাকায় পরিণত হয়েছে।”
কিন্তু এক সময়ে ব্যারাক স্কোয়ার ময়দানের মতো আরও ৫টি সুবিশাল ময়দান বহরমপুরে ছিল। উত্তর-দক্ষিণে বহরমপুরকে ভাগ করে জাতীয় সড়ক নির্মিত হওয়ায় সবুজে ঘেরা পাঁচটি সুবিশাল ময়দান ও ময়দানকে ঘিরে থাকা ব্রিটিশ আমলের দুর্লভ সব গাছ চিরতরে হারিয়ে গেল! কিন্তু স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেল প্রবীণ পুর-নাগরিকদের জীবনে। |
বহরমপুর শহরের পূর্বে ধোপঘাটি থেকে পশ্চিমে ভাগীরথী পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ছড়িয়েছিল ওই ময়দান
১) ধোপঘাটি থেকে সমবায়িকা পর্যন্ত ছিল টাউন ক্লাবের ময়দান। বর্তমানে ওই ক্লাবের কোনও অস্তিত্ব নেই। যেমন সাফ হয়ে গিয়েছে ময়দানের অস্তিত্ব।
২) গির্জার মোড়ে ছিল গাঁধী ময়দান। ৬০’র দশকে রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল গাঁধী ময়দানে অনুষ্ঠিত হত।
৩) কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুল ময়দান। এখন সরকারি আমলাদের বাসভবন।
৪) পুলিশ প্যারেড গ্রাউন্ড ময়দান। কার্পেটের মত সবুজ ঘাসে ঢাকা ছিল। সেই সময়ে হকিও খেলা হত। বর্তমানে সরকারি ট্যুরিস্ট লজ।
৫) এফইউসি ময়দান। আইএফএ শিল্ডের মত ঐতিহাসিক হুইলার শিল্ড প্রতিযোগিতার ফুটবল ম্যাচ খেলা হত।
ওই প্রতিযোগিতায় মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের মত কলকাতার বিভিন্ন দল খেলে গিয়েছে। ময়দান লাগোয়া মাঠে টেনিস কোর্ট ছিল। এখন সেখানে জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কার্যালয় ও প্রাণীসম্পদ দফতরের পলি ক্লিনিক।
এর আগে ব্যারাক স্কোয়ার ময়দানের চারপাশের রাস্তা বরাবর ৮০টি ত্রিফলা আলো দিয়ে সাজায় বহরমপুর পুরসভা। এতে সৌন্দর্য বাড়লেও ময়দানের সর্বত্র ওই আলো পৌঁছাত না। ফলে ওই ময়দানের চার কোনায় নতুন করে আরও চারটি এইচএমএল লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয় পুর-কর্তৃপক্ষ। সেই মত তারা ফরাক্কার এনটিপিসি-র কাছে আবেদন জানায়। ওই আবেদন মেনে এনটিপিসি কর্তৃপক্ষ ব্যারাক স্কোয়ারের পাশাপাশি পুরনো কান্দি বাসস্ট্যান্ড চত্বরে কাজি নজরুল ইসলাম সরণিতে, গির্জার মোড়, বহরমপুর রেল স্টেশন যাওয়ার পথে ক্ষুদিরাম মূর্তির কাছে এবং লালবাগ যাওয়ার রাস্তায় কুঞ্জঘাটা মোড়ে এইচএমএল বসানোর বিষয়টি মেনে নেয়।
বহরমপুরের পুরপ্রধান নীলরতন আঢ্য বলেন, “বহরমপুরের ফুসফুস ব্যারাক স্কোয়ার ময়দান। ঐতিহাসিক ওই ময়দানের চারপাশের অস্থায়ী দোকান-ঘর ভেঙে ফেলে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। ফরাক্কা এনটিপিসি’র সহায়তায় যেমন এইচএমএল আলো লাগানো হয়েছে, তেমনি ময়দানের চার দিক রাস্তা বরাবর পাঁচিল দিয়ে ঘিরে সবুজায়ন করা পাশাপাশি ওই রাস্তায় বেশ কয়েকটি সাউন্ড বক্স লাগানো হয়েছে।”
ব্রিটিশ বাস্তুকার কর্ণেল এ ক্যাম্পবেল-এর তত্ত্বাবধানে ১২৬.৯৫ একর জমির উপরে বহরমপুরে ১৭৬৫-১৭৬৭ সালে সেনা নিবাস গড়ে ওঠে। সেনা নিবাসকে কেন্দ্র করে প্রশাসনিক অঞ্চল, সেনা-ছাউনি, সেনা প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত ছাড়াও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরির উদ্দেশ্যেই ব্যারাক স্কোয়ার ময়দান তৈরি হয়। আড়াইশো বছরের প্রাচীন ব্যারাক স্কোয়ার ময়দানের আলো ও সবুজে মুড়ে দেওয়ায় খুশি বহরমপুরবাসী। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের অধ্যক্ষ সোমেশ রায় বলেন, “রাজ্য পুরাতত্ত্ব পরিষদ হেরিটেজ হিসেবে নোটিফিকেশন জারি করে। তার পরেও অযত্নে ও অবহেলায় পড়ে ছিল ওই ময়দান। প্রাতর্ভ্রমণের পাশাপাশি সান্ধ্যভ্রমণ করেন পুরবাসিন্দারা, তেমনি গরমের সময়েও মাঠে অনেক রাত পর্যন্ত বসেও থাকেন অনেকে। আলোকিত থাকায় নিরাপত্তার অভাব দূর হয়েছে। তাই ওই ময়দানে ভিড় বাড়ছে।” |