কংগ্রেসের চিন্তন শিবির হইতে নূতন চিন্তন কী বা কতটুকু উঠিয়া আসিল, তাহা বিশেষ পরিষ্কার নয়। কিন্তু পরিবারতন্ত্রের চতুর্থ (অথবা পঞ্চম) প্রজন্ম অবশেষে সকল কুয়াশা ভেদ করিয়া পরিষ্কার উঠিয়া আসিলেন। জওহরলাল নেহরুর পিতৃদেব হইতেই পরিবারের রাজনৈতিক বংশতালিকা গণনা বিধেয় মোতিলাল নেহরু ১৯১৯ সালে প্রথম বার জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হইয়াছিলেন। রাহুল গাঁধী ২০১৯-এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হইবেন কি না, তাহা ভোটদেবী জানেন, কিন্তু ভাইস প্রেসিডেন্টের ‘ভাইস’টুকু খসিয়া পড়িতে তত দিন অপেক্ষা করিতে হইবে, এমন আশঙ্কা তাঁহার মনে নিশ্চয়ই নাই। কংগ্রেস নামক দলটির এই দুর্মর পরিবারতন্ত্রকে সরাসরি অগণতান্ত্রিক বলিলে অন্যায় হইবে। দলনেতারা যথারীতি প্রবল উৎসাহে নেহরু-গাঁধী পরিবারের নায়কত্ব বরণ করিয়া লইয়াছেন, বিবাদী স্বর সম্পূর্ণ অশ্রুত, অন্তত প্রকাশ্যে। বস্তুত, গত কয়েক বছরে দল এই উত্তরাধিকারের জন্যই সর্বতোভাবে প্রস্তুত হইয়াছে, বিকল্প নেতৃত্বের কোনও কথাও ওঠে নাই, পরিবারতন্ত্রের জোগান প্রস্তুত হইবার আগেই তাহার চাহিদা সম্পূর্ণ প্রস্তুত হইয়াছে। সেই দিক দিয়া দেখিলে, পরিবারের শাসনকে ‘স্বাভাবিক’ করিয়া লইবার কাজটিতে সনিয়া গাঁধীর সাফল্য অতুলনীয় এবং নিরঙ্কুশ। নিরন্তর নেতৃত্বের সঙ্কটে জর্জরিত ভারতীয় জনতা পার্টির বহু কর্মী ও নেতা নিশ্চয়ই মনের ঈর্ষা মনে লুকাইয়া ভাবিতেছেন, উত্তরাধিকার নির্ধারণে তাঁহাদের ‘পরিবার’-এর তন্ত্রটি যদি এমন কার্যকর হইত!
‘যুবরাজ’ হিসাবে রাহুল গাঁধীর এই সহজ সরল অভিষেকই বলিয়া দেয়, কংগ্রেসের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা কোথায়। একটি গণতান্ত্রিক এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশে একটি জাতীয় দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রই তাহার দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের শ্রেষ্ঠ ভিত্তি হইতে পারে। বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে কংগ্রেসের মধ্যে যে গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের সম্ভাবনা দেখা যায় নাই, তাহাও নহে। উচিত ছিল সেই প্রক্রিয়াকেই সর্বত্র জোরদার করা, যাহাতে দল এক প্রসারিত এবং দৃঢ় ভিত্তির উপর গড়িয়া উঠিতে পারে। বিভিন্ন রাজ্যে মুক্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেতারা উঠিয়া আসিবেন এবং তাঁহারা আবার মুক্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সর্বভারতীয় স্তরে দল পরিচালনা করিবেন, ইহাই ছিল দেশের প্রাচীনতম দলটির নিকট গণতান্ত্রিক ভারতের দাবি। কিন্তু ইন্দিরা গাঁধী জমানা হইতে অর্ধ শতাব্দী যাবৎ দল তাহার বিপরীতে হাঁটিয়াছে, নেতৃত্বের বহুমাত্রিকতাকে গণতান্ত্রিক স্ফূর্তি দিবার পরিবর্তে ‘হাই কমান্ড’-এর শাসন নিরঙ্কুশ করিবার কাজে ব্যবহার করা হইয়াছে দ্বিতীয় সারির বিভিন্ন নেতা পরস্পরের শক্তি খর্ব করিতে পারিলে পরিবারের সুবিধা বাড়ে, সকলেই তখন সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিয়া বলে, ‘হাই কমান্ড স্বর্গ, হাই কমান্ড ধর্ম’। এই প্রণিপাতের পিঠে চড়িয়াই রাহুল গাঁধীর উত্তরণ। ইহা আর যাহাই হউক, গণতান্ত্রিক ভারতের পক্ষে শ্লাঘার বিষয় নয়। গণতন্ত্রের বৃহৎ তাৎপর্য ছাড়িয়া যদি তাহার ক্ষুদ্র অর্থে মনোনিবেশ করা যায়? রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস যদি নির্বাচনী রাজনীতিতে সফল হয়, তাহা হইলে দলীয় গণতান্ত্রিকতা বা যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শ লইয়া তাহার মাথা ঘামাইবার প্রয়োজন কী? এই ক্ষুদ্র এবং সীমিত প্রশ্নের উত্তরও কিন্তু আদৌ স্পষ্ট নয়। রাহুল গাঁধী বয়সে তরুণ, শুধুমাত্র এই ক্যালেন্ডার-নির্দিষ্ট সত্যটি বাদ দিলে তাঁহার রাজনৈতিক দক্ষতা, প্রজ্ঞা বা সাফল্যের কিছুমাত্র প্রমাণ এখনও দেখা যায় নাই। নির্বাচনী রাজনীতিই যদি বিচার্য হয়, তবে উত্তরপ্রদেশ এবং গুজরাতের নির্বাচনী অভিজ্ঞতা দুইটি অতিকায় প্রশ্নচিহ্ন হিসাবে তাঁহার পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইবে। রাজনীতিতে শেষ কথা বলিয়া সত্যই কিছু নাই, সুতরাং তিনি হয়তো অদৃষ্টপূর্ব উদ্যমে ও দক্ষতায় সেই প্রশ্নচিহ্নগুলিকে সমূলে উৎপাটন করিয়া জয়যাত্রায় অগ্রগামী হইবেন, তাঁহার জননী চিন্তন শিবিরে যে ‘তরুণ ভারত’-এর প্রতি মনোনিবেশ করিবার আহ্বান জানাইয়াছেন, তিনি হয়তো সেই তারুণ্যের শক্তিকে আপনার এবং আপন দলের শক্তিতে রূপান্তরিত করিবেন, বিপক্ষে নরেন্দ্র মোদী থাকুন বা না-ই থাকুন। তবে কি না, এ সকলই আপাতত সুখস্বপ্ন। নির্বাচনী রাজনীতি স্বপ্ন নয়, কঠোর বাস্তব। |