|
|
|
|
মা তো জানেন ক্ষমতা আসলে বিষ
রাতে আমার ঘরে এসে কাঁদছিলেন |
শঙ্খদীপ দাস • জয়পুর |
তিনি বলছিলেন ঠাকুমার কথা। বলছিলেন, “ছোটবেলায় যে দুই পুলিশ আমাকে ব্যাডমিন্টন খেলা শিখিয়েছিলেন, তাঁরাই এক দিন ঠাকুমাকে খুন করলেন।”
সেই প্রসঙ্গেই এল বাবার কথা, “সে দিন হাসপাতালে জীবনে প্রথম দেখলাম, বাবা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। আমার দেখা সব থেকে সাহসী মানুষ ছিলেন তিনি। তবু তাঁকে কাঁদতে দেখলাম সে দিন।”
এবং তার পরে মা: “গত কাল সকলে আমাকে অভিনন্দন জানালেন। রাতে মা আমার ঘরে এসে কেঁদে ফেললেন। কারণ তিনি জানেন, ক্ষমতার মধ্যে আসলে বিষ রয়েছে।”
ক্ষমতার অলিন্দে আনুষ্ঠানিক ভাবে পা-রাখার পরের দিন এটাই উপলব্ধি রাহুল গাঁধীর।
দলের দু’নম্বর পদে আসার পরে প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিচ্ছেন, মঞ্চে বসে আছেন মা সনিয়া, মঞ্চের পাশে বোন প্রিয়ঙ্কা। গোটা হল তো বটেই, সারা দেশ তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। দেখতে চাইছে, জওহরলাল নেহরু থেকে ইন্দিরা, রাজীব হয়ে যে ঐতিহ্য বহন করে চলেছে গাঁধী-নেহরু পরিবার, তার নবীনতম প্রজন্ম কী বলেন। কী দিশা দেখান।
বক্তৃতার পরে একাধিক তুলনা উঠে আসছে বিভিন্ন মহল থেকে। কেউ বলছেন, এটা যেন ভারতের বারাক ওবামার বক্তৃতা। কারণ, মার্কিন প্রেসিডেন্টের মতো রাহুলও বলেছেন বদলের কথা। শুধু বলেননি, জানতে চেয়েছেন হাজির কংগ্রেস কর্মী-নেতাদের কাছ থেকে, তাঁরা কি পরিবর্তন চান? সকলে ‘হ্যাঁ’ বলে চিৎকার করে উঠলে হাল্কা হাসি দেখা গেল রাহুলের মুখে। তার পরে জানালেন, তিনিও চান। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে কোনও বদল নয়। বরং সময় নিয়ে, ধীরেসুস্থে। বললেন, এই বদল আনতে পারে কংগ্রেসই। |
|
ছেলের বক্তৃতা শুনে আবেগতাড়িত সনিয়া। রবিবার। ছবি: পি টি আই |
বিজেপির মুখপাত্র নির্মলা সীতারামন আবার মিল খুঁজে পেলেন রাহুলের বাবার সঙ্গে। বললেন, “আমার মনে আছে, রাজীব যখন দলে প্রথম বড় দায়িত্ব নেন, খুব আবেগঘন বক্তৃতা দিয়েছিলেন। খুব খুব অনুপ্রাণিত করার মতো বক্তৃতা ছিল সেটা।”
আবেগ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল কংগ্রেস-মঞ্চের কাছেও। ছেলের কথা শুনে বাঁ হাতে চোখ মুছছিলেন মা সনিয়া। পাশেই বসেছিলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত। তাঁর চোখেও জল। হাত বাড়িয়ে অল্প চাপ দিলেন সনিয়ার হাতে। তার পরে হাত ধরে চুমু খেলেন। রাহুলের বক্তৃতা শেষ করতেই এগিয়ে গিয়ে চুমু খেলেন তাঁর কপালে। তত ক্ষণে বহু হাত উঠে আসতে চাইছে মঞ্চে। কেউ এগিয়ে দিচ্ছেন শাল, কেউ এগিয়ে দিচ্ছেন কিছু লেখা কাগজ। মায়ের পাশে বসে রাহুল চুমু খেলেন তাঁর গালে। পরে জড়িয়ে ধরলেন মাকে। মনমোহন সিংহ এগিয়ে
এসে জাপ্টে ধরলেন রাহুলকে। দু’জনের মুখেই তখন
চওড়া হাসি।
দলের একটা বড় অংশ বলছে, রাহুল ওই বক্তৃতায় দেখাতে চেয়েছেন, গত আট বছর ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে, কখনও ভাট্টা পারসলে কৃষকদের বাড়িতে ঢুকে, কখনও উত্তরপ্রদেশের দলিত মহিলা কলাবতীর দাওয়ায় বসে তিনি যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, তা কী ভাবে তাঁকে গড়ে তুলেছে। যিনি দলের দায়িত্ব নিতে তৈরি। দলকে দিশা দেখাতেও। দলের অধিকাংশ নেতারই বক্তব্য, কাল অভিষেকের পরে আজ রাহুলের এই আবেগ এবং যুক্তি, ইতিহাস এবং সমসাময়িক, সামাজিক সুরক্ষা ও আর্থিক সংস্কারের মধ্যে ভারসাম্য রেখে দেওয়া বক্তৃতা বুঝিয়ে দিল, তিনি তৈরি। এবং সনিয়া গাঁধীকে কার্যত নিয়ে গেল রাজমাতার ভূমিকায়। সম্প্রতি কংগ্রেস শীর্ষ নেতাদের সনিয়া জানিয়েছেন, আর চার বছর। তার পরে অবসর নেবেন তিনি। এ বার রাহুলের অভিষেকের পরে, সংগঠন থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে রাহুলের দেখানো দিশার পরে তাঁর কাজ যে হাল্কা হয়ে গেল, সেটা দলের অনেক নেতাই মেনে নিচ্ছেন।
কী ভাবে দিশা দেখালেন রাহুল? কী ভাবে ভারসাম্য রাখলেন
সব ক্ষেত্রে? আজ দু’ভাষায় বক্তৃতা করেন রাহুল, ইংরেজি এবং হিন্দিতে। ইংরেজিতে বললেন দক্ষিণ ভারতীয়দের চাহিদা মেনে। হিন্দিতে বললেন মূলত উত্তর ভারতের কথা মাথায় রেখে। তিনি দেশের ইতিহাসকে জুড়লেন দলের ইতিহাসের সঙ্গে, দলের ইতিহাসকে জুড়লেন পরিবারের ইতিহাসের সঙ্গে। বললেন, “১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের তাড়িয়েছিলাম আমরা, অহিংসার সাহায্যে। কংগ্রেস পার্টি বলেছিল, আমরা হিংসার ব্যবহার করব না।” তার পরেই তিনি জানান, লাখ লাখ মানুষের আওয়াজকে নিয়ে এই স্বাধীনতার লড়াই চালিয়েছিলেন গাঁধীজি। সেই সাফল্য পাথেয় করে এগিয়ে গিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু। পরের ৬০ বছরের ইতিহাস বলতে গিয়ে তিনি এনেছেন ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ থেকে তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকাশের কথা। জানিয়েছেন, কী ভাবে সড়ক থেকে তথ্যপ্রযুক্তি, মানুষ থেকে সংবাদমাধ্যম সব ক্ষেত্রে যোগাযোগ সহজতর হয়েছে। এর সঙ্গে জুড়েছেন বাবার কথা। জানিয়েছেন, ১৯৮৪ সালে ঠাকুমা ইন্দিরা যখন মারা যান, ভারত তখন গভীর সঙ্কটে। অথচ আজ এই দেশই বিশ্বের ভবিষ্যৎ। এই দেশের কথা সবাই বলছে, সবাই শুনছে। এই উত্তরণের পিছনে কংগ্রেস সরকারের সামাজিক কাজের গুরুত্ব যে যথেষ্ট, সে কথাও জানিয়েছেন। বলেছেন আধার কার্ডের কথা। বলেছেন সরাসরি গরিবদের হাতে ভর্তুকি পৌঁছনোর কথা। আর সে কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন, “আমার বাবা বলতেন, এক টাকার মাত্র ১৫ পয়সা মানুষের হাতে পৌঁছয়। আজ আমরা সেই ব্যবস্থা তৈরি করেছি যেখানে এই প্রশ্নের জবাব মিলবে। ৯৯% মানুষের হাতে টাকা পৌঁছবে।”
একই সঙ্গে রাহুল উল্লেখ করেছেন যুব সম্প্রদায়ের সাম্প্রতিক রাগের কথাও। বলেছেন, “আমাদের যুব সম্প্রদায় এত রেগে গিয়েছে কেন... তারা পথে নেমেছে কেন.... তারা ক্রুদ্ধ কারণ তারা বিচ্ছিন্ন... তারা রাজনৈতিক নেতাদের থেকে বিচ্ছিন্ন। তারা রাস্তার ধার থেকে দেখে, লাল বাতি জ্বালিয়ে ক্ষমতাবানরা চলে যাচ্ছেন।” বলেছেন মেয়েদের কথা: “মহিলাদের কেন ভুগতে হচ্ছে। কারণ, কিছু লোক তাঁদের কণ্ঠরোধ করছেন।” বলেছেন গরিবদের কথা: “কেন গরিবরা ক্ষমতাহীন এবং গরিবির মধ্যে বন্দি... কারণ তাঁদের জীবন নিয়ে যাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন, প্রয়োজনে যাঁদের কাছে গিয়ে জবাব চাইতে পারবেন ওই গরিবরা, তাঁরা অনেক দূরের বাসিন্দা।” বললেন, “বন্ধ ঘরে বসে এক দল মানুষ সারা দেশের সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।” |
ছোটবেলায় আমি ব্যাডমিন্টন খেলতে ভালবাসতাম। যে দুই পুলিশকর্মী আমার ঠাকুমাকে রক্ষা করতেন, তাঁরাই আমাকে খেলা শিখিয়েছিলেন। তাঁরাই আমার বন্ধু ছিলেন। এক দিন তাঁরা ঠাকুমাকে খুন করেন। আমার জীবনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। বাবা তখন বাংলায় ছিলেন। তিনি এলে আমরা হাসপাতালে যাই। জীবনে প্রথম দেখলাম, বাবা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। আমার দেখা সব থেকে সাহসী মানুষ ছিলেন তিনি। তবু তাঁকে কাঁদতে দেখলাম সে দিন।.... কাল সকলে আমাকে অভিনন্দন জানালেন। রাতে মা আমার ঘরে এসে কেঁদে ফেললেন। কারণ তিনি জানেন, ক্ষমতার মধ্যে আসলে বিষ রয়েছে।
রাহুল গাঁধী |
জয়পুরের সঙ্কল্প |
• ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে একজোট হওয়ার ডাক
• প্রধানত রাজনৈতিক ও আমলা স্তরে দুর্নীতি রোধ
• আর্থিক বৃদ্ধি ও সামাজিক সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা
• খাদ্য সুরক্ষা আইন, ভূমি সংস্কার ও কৃষিতে উৎসাহ
• ‘নাবার্ড’-এর ধাঁচে মহিলাদের জন্য জাতীয় ব্যাঙ্ক
• ১৮-৬০ বছরের পরিত্যক্তা ও বিধবাদের পেনশন
• সোশ্যাল মিডিয়া সামলাতে ব্লক স্তরে আইটি সেল |
|
রাহুল গাঁধী নিজেকে বড় জাতীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন আজ।
একই সঙ্গে
সেই সব সমালোচকদের চুপ করিয়ে দিলেন, যাঁরা ওঁকে নিয়ে প্রশ্ন তুলছিলেন।
দিগ্বিজয় সিংহ |
|
ভারতকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য রাহুলই যোগ্যতম নেতা।
শীলা দীক্ষিত |
|
একটা ঐতিহাসিক বক্তব্য। নতুন ভারতের জন্য একটা দিশা দেখালেন তিনি।
সচিন পায়লট |
|
যাঁরা শুনছিলেন, তাঁদের মনে হয়েছে, শাসক দলের প্রতি ক্ষোভে ঠিক এই কথাগুলোই বলে থাকেন সাধারণ মানুষ। বিজেপি-র নেতারা ভাল ভাবেই বুঝতে পারেন এ দিন, এই কথাগুলো বলে আসলে তাঁদের মুখের কথাই কেড়ে নিয়েছেন রাহুল। তাই বিজেপি মুখপাত্র নির্মলা সীতারামন বলেন, “রাহুল তো বিরোধী দলের নেতাদের মতো কথা বলছিলেন।” শুধু বিজেপি-ই নয়, যে অণ্ণা হজারে-অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সামাজিক আন্দোলন এত দিন সামলাতে হয়েছে ইউপিএ সরকারকে
এ দিন এই ভাবে যেন তারও জবাব রাহুল দিয়ে দিলেন বলে মনে করছে কংগ্রেস নেতাদের একাংশ।
রাহুল সাংগঠনে বৈপ্লবিক পরিবর্তনেরও ডাক দিয়েছেন। বলছেন, “কংগ্রেসে কোনও নিয়মই নেই। তাই বদলের প্রয়োজন।” তা রূপায়ণের যে দাওয়াই একই সঙ্গে দিয়েছেন, তাতে পরিণত বুদ্ধির ছাপ রয়েছে বলেই মত প্রবীণ নেতাদের। বলেছেন, “ইদানীং পার্টিতে নেতার অভাব। এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে, যাতে প্রতিটি রাজ্যে কংগ্রেসের অন্তত দশ জন থাকবেন, যাঁদের মধ্যে যে কোনও এক জনকে মুখ্যমন্ত্রী করা যেতে পারে।” এত দিন যুব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবেই পরিচিত ছিলেন তিনি। এ দিন জানালেন, শুধু নবীন নয়, প্রবীণদেরও প্রতিনিধি তিনি। বললেন, “ক্ষমতার জন্য ক্ষমতা চাই না। ক্ষমতা চাই, মানুষের ক্ষমতায়নের জন্য।” এখানেও দেশের সঙ্গে দলকে যুক্ত করেন, “কংগ্রেস পার্টি ও দেশের মানুষই আমার জীবন। যত দিন বাঁচব দল ও দেশের জন্য লড়াই করব।”
প্রতি দু’কথা অন্তর হাততালিতে ফেটে পড়ছিল হল। হাততালি দিচ্ছিলেন কংগ্রেসের নেতা, আধা নেতা, কর্মী-সমর্থকেরা। কিন্তু তাতেও প্রশ্নটা পুরোপুরি ওড়ানো যায়নি। রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, হলের এই হাততালি, জনপ্রিয়তা, সব কিছু সাধারণ মানুষকে ছুঁতে পারবে তো? যে ২০১৪ সালের যুদ্ধের জন্য এ দিন দামামা বাজালেন রাহুল, দলকে সেই বৈতরণী পার করাতে পারবেন তিনি? কংগ্রেস নেতারা বলছেন, বক্তৃতা জুড়ে আশার কথা শুনিয়েছেন রাহুল, বলেছেন, শুধু আশাই পারে মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এই বক্তৃতার পরে অন্তত প্রথম রাউন্ডে তো এগিয়ে গেলেনই বিজেপির সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীর থেকে। বাকিটা সময় বলবে। |
|
|
|
|
|