টিভি নেই, হেডফোন কানে আফসোস আরাবুলের
বিছানায় আধশোয়া হয়ে হেডফোনে গান শুনছেন। চোখ বোজা। মেজাজে অল্প অল্প মাথা দোলাচ্ছেন। পাশে কয়েকটা দৈনিক সংবাদপত্র। ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে ওষুধ, জলের গ্লাস। তাঁর খেদ, “একটা টিভি থাকলে বেশ হত। কোথায় কী হচ্ছে, তার সব খবরাখবর পাওয়া যেত। কিন্তু এখানে তো টিভি পাওয়া যায় না।”
তিনি আরাবুল ইসলাম। পুলিশ হাজতে বুকে ব্যথা হয়েছিল বলে দাবি করেছিলেন। তাই বাঙুর হাসপাতাল ঘুরিয়ে তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছে এসএসকেএমে। শুক্রবার গভীর রাত থেকে সেখানকার আইসিসিইউ-এর সাত নম্বর শয্যায় তিনি ভর্তি। আরাবুলের ঠিক কী হয়েছে, তিনি কেমন আছেন তা সরেজমিনে জানতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম রবিবার বিকেলে। পৌঁছলাম আরাবুলের শয্যার পাশে। কোনও ভাবে তাঁর ধারণা হয়েছিল এই প্রতিবেদক বোধ হয় স্বাস্থ্য দফতর থেকে আসা কোনও কর্মী (তাঁর সেই ভুল আমরা ভাঙাইনি)।
ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিওভাস্কুলার সায়েন্সেস-এর এক তলায় আইসিসিইউ। বিকেল সাড়ে চারটে। বাড়ির মূল গেট দিয়ে ঢোকার পরেই চোখে পড়ল, কয়েকটা চেয়ারে হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে গল্প জমিয়েছেন আরাবুলের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্মীরা। পুলিশ হেফাজতে থাকা রোগীর কাছে কে, কখন আসছেন তা নিয়ে সতর্ক মনে হল না কাউকেই। ওয়ার্ডে ঢোকার পরে আরাবুল ইসলাম কোন শয্যায় আছেন, তা জানতে চাইলে কর্তব্যরত চতুর্থ শ্রেণির কর্মী অদূরে একটি শয্যার দিকে আঙুল দেখালেন। ভিজিটিং আওয়ারে অন্য রোগীরা কেউ জেগে, কেউ শয্যায় বসে বাড়ির লোকের অপেক্ষা করছেন। শুধু সেই শয্যাটি ব্যতিক্রম! চারপাশে খয়েরি পর্দা দিয়ে ঘেরা। বাইরে থেকে দেখার উপায় নেই। পর্দা সরাতেই নজরে পড়ল আধশোয়া হয়ে গান শুনছেন আরাবুল।
বিরক্ত এবং জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন ভাঙড়ের তাজা (এক মন্ত্রীর দেওয়া বিশেষণ) তৃণমূল নেতা।
প্রশ্ন করি, কেমন আছেন? খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো হচ্ছে? তিক্ত মুখে উত্তর দিলেন, “কেন? কী দরকার?” তার পর বলতে থাকেন, “খাওয়াদাওয়ার ঠিকঠাক ব্যবস্থা তো বাড়িতে থাকে। এখানে একেবারেই হচ্ছে না। বাড়িতে যা যা দেয় বলেছিলাম, সে সব দেয়নি। ডাক্তারদের বলব, এ ভাবে কি চলতে পারে?” হাসপাতাল সূত্রে খবর, এ দিন দুপুরেও তাঁকে সব্জি আর চিকেন স্টু দেওয়া হয়েছিল। তিনি খুশি মনে খাননি।
আর শরীর? আরাবুল বললেন, “ভাল নয়, বুকে ব্যথাটা মাঝেমধ্যেই হচ্ছে।”
যাঁর অধীনে এই তৃণমূল নেতার চিকিৎসা চলছে, সেই সইদুল ইসলাম কিন্তু রোগীর শারীরিক অবস্থা নিয়ে কোনও কথা বলতেই রাজি নন। এ দিন সন্ধ্যায় যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “রোগীর শারীরিক অবস্থা আমার কাছে কেন জানতে চাইছেন? যা বলার কর্তৃপক্ষ বলবেন।”
কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ এসএসকেএমের অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র এবং সুপার তমালকান্তি ঘোষ একই সুরে জানান, যা বলার তা ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসকই বলতে পারেন। আরাবুলের অবস্থা কি আইসিসিইউ-তে থাকার মতো? প্রদীপবাবু বলেন, “আমাদের কিছু বলার নেই। চিকিৎসক বলেছেন আইসিসিইউ দরকার। তাই আইসিসিইউ-এ আছেন। সোমবার বোর্ড বসছে। তখন বোর্ড যা বলবে, তাই করব।” একই বক্তব্য সুপারেরও।
সে কথা উল্লেখ করে চিকিৎসক সইদুল ইসলামের মতামত জানতে চাওয়ায় এ বার তিনি কিছুটা উত্তেজিত। তাঁর জবাব, “এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি নই। বাধ্যও নই।” আরাবুলের মতো উপসর্গ নিয়ে যে কেউ এলে তাঁদেরও কি আইসিসিইউ-তেই ভর্তি করবেন তাঁরা? অধিকর্তা ও সুপার দুজনেই তো বলছেন আপনার কথাতেই আরাবুল আইসিসিইউ-তে রয়েছেন। সইদুল ইসলামের জবাব, “অদ্ভুত ব্যাপার! এটা ওঁরা কী ভাবে বলছেন সেটাই বুঝতে পারছি না। সবাই আমার উপরে সব কিছু চাপাচ্ছে। আমি কোনও কথা বলব না।”
শনিবার আরাবুলকে দেখতে আইসিসিইউ-এর ভিতরে ঢুকেছিলেন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, রাজারহাট-নিউটাউনের বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত, দক্ষিণ ২৪ পরগনা তৃণমূলের ক্যানিং ২-এর সভাপতি সওকত মোল্লা-সহ তৃণমূলের বেশ কয়েক জন নেতা-কর্মী। রবিবার সকালেও কয়েক জন নেতাকে ওয়ার্ডে দেখা গিয়েছে। এ দিন বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে আরাবুল বহু ক্ষণ গল্প করেছেন বলেও হাসপাতাল সূত্রে খবর। অথচ পুলিশ হেফাজতে থাকা এই রোগীকে পুলিশ এখনও জেরা করে উঠতে পারেনি।
যে ওয়ার্ডে গুরুতর অসুস্থ রোগীরাই থাকেন, যে ওয়ার্ডকে সংক্রমণমুক্ত রাখার জন্য সব সময়ে সতর্ক থাকা জরুরি, সেখানে এত লোকজন এক সঙ্গে ঢুকে পড়েন কী ভাবে, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। তার পরেও পরিস্থিতি যে বদলায়নি, তা এ দিন সহজে ওয়ার্ডে পৌঁছতে পারাতেই বোঝা গেল। ওয়ার্ডের কর্মীরা জানিয়েছেন, আরাবুলকে তাঁরা মোবাইল ফোনে কথাও বলতে দেখেছেন। কী ভাবে আইসিসিইউ-এ পুলিশ হেফাজতে থাকা রোগীর কাছে গান শোনার যন্ত্র বা মোবাইল ফোন পৌঁছে যাচ্ছে? সুপারের বক্তব্য, “এটা দেখা তো পুলিশের কাজ। আমরা বারবার পুলিশকে এটা জানিয়েছি। আসলে বোঝেনই তো, কোনও কোনও রোগী কথা শোনেন না। আমরা কত দিকে খেয়াল রাখব?”
সুপার জানিয়েছেন, আরাবুলের অবস্থা স্থিতিশীল। রক্তে শর্করার পরিমাণ খানিকটা বেড়ে যাওয়ায় এ দিন ইনসুলিন দেওয়া হয়েছে। তবে রক্তচাপ স্বাভাবিক। সোমবার মেডিক্যাল বোর্ড তাঁকে পরীক্ষা করবে। তার পরেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.