|
|
|
|
আনন্দplus এক্সক্লুসিভ |
স্বপ্নে দেখলাম সুনীল তাস খেলছে
অক্টোবরের চরম শোকবিজড়িত তারিখের ঠিক ৯০ দিন বাদে ফিরে ফিরে দেখা! কখনও বা
বুঝতে চাওয়া অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে! দূর বস্টনে ছেলের বাড়ি থেকে টেলিফোনে গৌতম ভট্টাচার্য-র সঙ্গে
কথা বললেন স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়। সুনীলের মৃত্যু-পরবর্তী তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার |
শুনলাম ফেব্রুয়ারির ২-৩ তারিখে কলকাতায় ঢুকছেন। ভরা বইমেলা তখন। বইমেলা আছে সুনীল নেই, ভাবতে পারবেন?
মন খারাপ তো লাগবেই। বইমেলায় প্রতি বছর ওর সঙ্গে যেতাম। সঙ্গে হেঁটে যে স্টলগুলো ঘুরতাম তা নয়। সুনীল ঢোকা মানে তো সেই ভিড়ভাট্টা। সঙ্গে লোকজন। আমি তা থেকে দূরেই থাকতাম। কিন্তু লক্ষ্য থাকত ওর ওপর। ইদানিং যখন পড়েটড়ে যাচ্ছিল ওর একটু কাছাকাছি থাকাটা দরকার ছিল।
সুনীলের মৃত্যুর পরে শহরের প্রতিক্রিয়া দেখে কি মনে হয়েছিল আর পাঁচটা কারণে যতই দূরছাই হোক শহরটার। আজও কলকাতা সাহিত্যিকের মৃত্যুতে রক্তাক্ত হতে পারে!
আমি সত্যি ভাবিনি এ রকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে। আমি, আমার ছেলে আলোচনাও করছিলাম স্মরণসভায় সেই ভিড়ের কথা। আমরা বুঝিইনি যে এত মানুষ এমন ভিড় করবেন। তা হলে অন্য জায়গা নিতাম। আরও বড় জায়গা। আমাদের মনে হয়েছিল রবীন্দ্রসদনই তো যথেষ্ট বড়। এর পর যা দেখলাম সত্যি অভিভূত।
স্মরণসভায় ওই রকম ভিড় কলকাতাও সাম্প্রতিক কালে দেখেনি। সুনীলের কত বন্ধু-বান্ধব ঢুকতে পারেননি। শিল্পী যোগেন চৌধুরী দেড় ঘণ্টা ধস্তাধস্তি করে তার পর ভেতরে ঢুকতে পারেন।
আমি জানি। সে দিন অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটেছে। অনেকে রবীন্দ্রসদনের ভিতরে ঢুকতে না পেরে বাইরে স্মরণসভা করেছেন। আমার সত্যিই অবাক লেগেছে। এই যে শুনি আজকাল সাহিত্যিকদের কদর কমে গেছে! টরেন্টো থেকে সে দিন লোকজন বলছিল, সাহিত্যের জন্য জায়গা বা টাকা খরচ করাটা, এখন বঙ্গসম্মেলনগুলোতেও সমস্যা হয়ে গিয়েছে। সেখানে এই রকম রিঅ্যাকশন ভাবাই যায় না। সুনীল পরজন্মে বিশ্বাস করত না। বলত মৃত্যুর পর সব শেষ। সব শূন্য। আজ মনে হয়, যদি ও কোথাও দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে পেত, তা হলে ওরও বোধহয় অবাক লাগত। ভাবত লোকে আমায় এত এত ভালবাসে।
২৩ অক্টোবর থেকে আজ ৯০ দিন পেরিয়ে গেল। বদলে যাওয়া সময় কী ভাবে ধরা দিচ্ছে? শুধুই যন্ত্রণা, নাকি স্মৃতিগুলো টাটকা হয়ে চেপে ধরা?
কী রকম ভাবে যে ব্যাপারটা চলতে থাকে বোঝা যায় না। সবাই জানে জন্ম আছে, মৃত্যু আছে। কিন্তু মৃত্যু হলে আস্তে আস্তে টের পাওয়া যায়। প্রথম একটা মাস অনেক লোকজনের মধ্যে হকচকিয়ে ছিলাম। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলছিল। প্রথম মাসের মধ্যে আনন্দ পাবলিশার্সে গেছি, অ্যাডভোকেটের কাছে গেছি। তেমন কিছু বুঝিনি। তার পরেই ছেলে আমেরিকা নিয়ে চলে এল। ভাগ্যিস নিয়ে এসেছিল, খারাপ লাগাটা তখন সবে শুরু হচ্ছিল। আমেরিকায় এসে বৌমার মায়ের সঙ্গে খুব আড্ডা মারছি। নাতির সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি। মাঝখানে একটু অসুস্থও হয়ে পড়লাম। সময়টা কেটে যাচ্ছিল। এখন এই যে কলকাতায় ফেরার ভাবনা শুরু হয়েছে, তার সঙ্গে কেমন যেন একটা অনিশ্চয়তা এসে গিয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, ওকে জিজ্ঞেস করে নেব। তারপরেই বাস্তবটা ফিরে আসে ও-ই তো নেই। কৃত্তিবাসের যে ছেলেগুলো প্রতি রবিবার আসত, তারা কি আসবে? হয়তো আসবে। ফিরে গিয়ে কী পাব, কী নিয়ে থাকব, কিছুই জানি না। চিরজীবন সুনীলকে বলে এসেছি তুমি আমায় সময় দাও না। আজ সময় পেয়েও ও থাকছে না।
সময় কম পাওয়া নিয়ে কি আপনার অভিযোগ ছিল?
আমি মাঝে মধ্যে বলতাম যে, তোমায় আমাকে ঐশ্বর্যে-সম্পদে রাখতে হবে না। আমাকে শুধু একটু সময় দিও। তবে এটাও ঠিক আড্ডা দিতে অনেকে বাড়িতে আসত। তখন আমরা একসঙ্গেই আড্ডা মারতাম। |
বুদাপেস্টে এক রেস্তোরাঁয়। ২০১১-র মে। সুনীল-স্বাতীর শেষ বিদেশ সফর |
‘মিশর রহস্য’ শ্যুটিং শুরু হয়েছে জানেন?
জানতাম না তো। ওর কাকাবাবুর এই গল্পটা ছবি হওয়া নিয়ে খুব আগ্রহ ছিল। ‘মনের মানুষ’ দেখে প্রসেনজিৎকে ওর খুব পছন্দ হয়েছিল। খুশি হয়েছিল জেনে যে প্রসেনজিৎ কাকাবাবু করবে। তার পর আবার কাগজে পড়ল যে ছবিটাই হচ্ছে না। তখন হতাশ ভাবে বলল, যাঃ আটকে গেল। কী আর করা যাবে। মারা যাওয়ার আগে অবশ্য সুনীল শুনে গিয়েছিল ফিল্মটা যে হচ্ছে।
মৃত্যুর পর সুনীল সম্পর্কে লেখালিখি সব আপনি পড়েছেন?
কিছু পড়েছি। শুনেওছি। কিছু কিছু লেখা আমার ভাল লাগেনি। কোনও কোনও লেখক যেন এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে লোকটা শুধু মদ খেত আর প্রেম করত। একটা মাতাল প্রেমিক গোছের স্টিরিওটাইপ লক্ষ করেছি। আমার মনে হয়েছে এটাই কি মেন জিনিস ছিল ওর? হ্যাঁ জীবনে হয়তো দু’টো দিক ছিল ওর। কিন্তু সুনীল তো এক নানান ডায়ামেনশনের মানুষ। ও যে কত মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকেছে তা কি কেউ জানে? কেউ কি জানতে চেয়েছে এই তথাকথিত প্রেমিক তকমা দেওয়া মানুষটার আড়ালে কী অসম্ভব ডিসিপ্লিনড লোক লুকিয়ে ছিল? কী অসম্ভব পরিশ্রম ও লেখার জন্য করেছে! কী সাঙ্ঘাতিক খাটনি ও খেটেছে, কাছের লোকরাই শুধু জানে! শান্তিনিকেতনে বসে আমরা একবার লোডশেডিং হয়ে গেছে। কুলকুল করে ঘামছি, তার মধ্যে সুনীল লিখে যাচ্ছে। আমি একবার বললাম বন্ধ করো না। ও বলল, না স্বাতী আমার লেখা শেষ করতেই হবে।
মৃত্যু সম্পর্কে সুনীল কিছু বলতেন টলতেন?
সুনীল মৃত্যু নিয়ে বেশি কথা বলতেই চাইত না। কথা বলতাম আমি। ও মৃত্যু নিয়ে আলোচনা তুললেই বলত, মরবিড কথাবার্তা বোলো না। যখন যাব তখন দেখা যাবে। আমি বলতাম না আমাদের মধ্যে যেন তুমি প্রথম যাও। তোমার ওষুধ-টষুধ তো কোথায় আমিই সব জানি। তোমার কোনও ধারণাই নেই। আমি চলে গেলে সুনীল একেবারে অসহায় হয়ে পড়বে এই ভয়টা ছিল।
সত্তর দশকের তরুণ চার কবি-সাহিত্যিকের সম্পর্কে গর্ব করে বলা হত “মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করে চারজন যুবক।” সুনীল, শক্তি, শরৎ আর ভাস্কর। সুনীলকে ধরা হত এদের নেতা বিশেষ। অথচ জীবনের শেষ মধ্যরাতে যখন চিকিৎসক বা দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন হল, তখন সুনীল হয়ে গেলেন কার্যত শোষিত। কী লাভ তা হলে এমন কলকাতা শাসন করে?
আসলে সেলিব্রিটি হলে তার নানান রকম সমস্যাও থাকে। স্ট্রং নিজস্ব মতামত থাকে। সুনীল যেমন বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে কিছুতেই রাজি ছিল না। ডাক্তার দেখানো পছন্দ করত না। হাঁটুর অপারেশনও ও কলকাতাতেই করল। তার পর ক্যানসার ধরা পড়ার পর ও পিজির হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট ড. মজুমদারকে গিয়ে বলল, কোয়ালিটি অব লাইফ ভাল থাকাটা বেশি জরুরি, কেতরে কেতরে লম্বা লাইফের চেয়ে। আমরা মুম্বইতেও গিয়েছিলাম চিকিৎসা করাতে। তখন থেকেই সুনীলকে দেখে মনে হচ্ছিল যে মনের মধ্যে কোথাও যেন আর বাঁচা দরকার নেই ধরে নিয়েছে। হাঁটতে পারছিল না। ধরে ধরে হাঁটাতে হত। খেতে পারছিল না। বাওয়েল মুভমেন্ট কন্ট্রোল করতে পারছিল না। যেখানে বসছিল সেখানে হয়ে যাচ্ছিল। এ সবে ও খুব অসম্মানিত বোধ করছিল। আমি সুনীল গাঙ্গুলি! আমার নিজের ওপর কোনও কিছুতে নিয়ন্ত্রণ নেই। আমাকে লোকের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এইটা ওর আত্মসম্মানে ভীষণ লাগত। উদাসীন হয়ে গিয়েছিল, কথা প্রায় বলত না। নেগেটিভ মনে হত। আমি তখন ওকে বলতাম, নেগেটিভ তো চিরজীবন ছিলাম আমি, তুমি তো বরাবরের পজিটিভ। তোমার কী হল? মাঝে মাঝে পড়ে যেত। ও পড়ে যাওয়াতে একবার বাড়িতে টেবিলের কাচ ভেঙে গেল। তখন ও আরও ডিপ্রেসড হয়ে গেল। শেষ দিকে যেন সুনীল চলে যেতেই চেয়েছিল, আর বাঁচতে চায়নি।
বলতে চাইছিলাম যে বোহেমিয়ান মনোভাব একটা দারুণ ইমেজারি দিয়েছিল। মৃত্যুর সময় দেখা গেল সেটা মূল্যহীন। বরং মধ্যরাতে ডাক্তারদের মেকানিজমটা নিখুঁত থাকলে ভাল ছিল।
আমি ঠিক সে ভাবে বলব না। সেভাবে ভাবলে হয়তো সুনীল সুনীলই হত না। আমার আক্ষেপ হত শেষ দিকে ও বড় চাপ নিয়ে ফেলছিল। নিজের লেখালেখি যার চাপ দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছিল। সাহিত্য একাডেমি, ‘বেঙ্গল’ সংস্থার কাজ দেখা। তবে ওই বোহেমিয়ান মনোভাবটা যদি বলেন, ওটা আমার দারুণ লাগত। সুনীলের প্রতি আকর্ষণ বোধহয় সেটার জন্যই।
স্তাবকদের একটা বৃত্ত নাকি ওঁকে ঘিরে থাকত বলে শোনা যায়। তারা কি মৃত্যুর পরে ভোঁ-ভাঁ?
(কিছুটা অস্বস্তি) অনেকেই আমাদের পাশে রয়েছেন, যাঁরা ছিলেন। ব্যক্তি বা সংস্থা। তাঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। একই সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কারও কারও কাছে আঘাতও পেয়েছি। তারা এমন ব্যবহার করবে আশাও করিনি। তবে এগুলো নিয়ে আজ আর কথা বলতে চাই না। |
|
এখনও কথা বলেন ওঁর সঙ্গে?
অনেক কথাই বলি। ভুল করে বলে ফেলি। আবার কখনও স্বপ্নেও দেখি। এমনিতে আমি মোটেও স্বপ্ন দেখা টাইপ নই। অথচ সে দিন স্বপ্ন দেখলাম, একটা গ্রুপ একসঙ্গে বসে তাস খেলছে। তাদের কেউ কেউ ড্রিঙ্ক করছে। সুনীলকে দেখলাম অন্য দিকে ঘুরে তাস খেলছে। তার পর স্বপ্নটা ভেঙে গেল। মনেই থাকে না যে ও আর নেই। এখন বারবার মনে হয়, কত কথা বলার ছিল। আর তো কোনও দিন বলা যাবে না।
স্বামীকে এখনই ডাকতে হলে ওঁর লেখালিখি থেকে কোন লাইনটা ব্যবহার করবেন?
‘ভ্রূপল্লবে ডাক দিলে/দেখা হবে চন্দনের বনে’ (কিছুক্ষণ সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ)
সুনীল বলে যাননি নীরা কে? আপনি জানেন নীরা কে?
নীরা একজন কেউ নয়। পাঁচ-ছ’জনকে ঘনিষ্ঠ ভাবে দেখা থেকে তৈরি অবয়ব। একজন পুরুষ সারা জীবন একটা প্রেম করে যাবে এমন তো হয় না। স্ত্রীকে ভাল লাগাটা নিশ্চয়ই থাকে কিন্তু সে অন্য রকম। তার পাশে এইগুলোও থাকে। পড়েছি সেই প্রাচীন আমলে বসন্ত উৎসবের দিনে পুরুষ-নারী মিলে সকালে সুরা পান করত। তার পর সেই দিনটায় পুরুষ-নারীর মেলামেশায় কোনও ভেদাভেদ থাকত না। আমার মনে হয় আজও একজন নারী একজন পুরুষকে পুরোপুরি পায় না। পাওয়া সম্ভবও নয়।
সুনীলকে নিয়ে আশেপাশের মহিলাদের এই মুগ্ধতা আর ঢলে পড়ার মধ্যে নিজেকে কখনও অবাঞ্ছিত মনে হয়েছে?
মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে। এক এক দিন মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। কোনও কোনও ক্ষেত্রে মনে হত ও কেন বুঝতে পারছে না। ঝগড়াও হয়েছে। পরে অবশ্য মনে হত এত বড় লেখক-সেলিব্রিটি তাকে একজন মানুষ কী করে পুরোপুরি পেতে পারে? আজ মনে হয়, কেউ নিশ্চয়ই রয়েছে। আরও কেউ হয়তো ভগ্ন হৃদয়ে বসে রয়েছে। আরও কেউ হয়তো আমারই মতো দুঃসহ একাকিত্বের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সুনীলকে আমি তো আর পুরোপুরি নিজের বলে দাবি করতে পারি না। |
|
|
|
|
|