এ বার মাটি উৎসব!
সরকারি বদান্যতায় জঙ্গলমহল উৎসব, বিবেক উৎসব, সৈকত উৎসব সবে মিটেছে। পরবর্তী আকর্ষণ উত্তরবঙ্গ উৎসব। এবং তা শেষ হতে না হতেই ফেব্রুয়ারির গোড়ায় মেলার আঙ্গিকেই মাটি উৎসব করতে চলেছে রাজ্য সরকার।
কেন নতুন করে এই উৎসবের অবতারণা?
রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা বলছেন, মাটি-মানুষে যোগাযোগ কত গভীরে, উৎসবের মাধ্যমে সে কথাই আমজনতাকে বোঝাবে রাজ্য সরকার।
শুধু মাটি উৎসব নয়, গত ২০ মাসে অন্তত এক ডজন মেলা-উৎসবে খয়রাতির জেরে রাজ্যের আর্থিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে বলে মনে করছেন অর্থ দফতরের কর্তারা। আর তার জেরেই ধাক্কা খাচ্ছে উন্নয়নের একাধিক প্রকল্প। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “লাগামহীন খরচের জেরে বাজার থেকে ধার নেওয়ার সীমা এখনই প্রায় শেষের মুখে। জানুয়ারি মাসেও ৮০০ কোটি টাকা ধার নিচ্ছে সরকার। এবং তা নিলে বাজার থেকে নেওয়া ধারের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকায়। বাকি দু’মাসের জন্য হাতে থাকবে সাকুল্যে ২০০০ কোটি টাকারও কিছু কম।”
আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি বর্ধমানের পানাগড়ে মাটি উৎসবের সূচনা হবে। চলবে সাত দিন। এখনও পর্যন্ত ঠিক আছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উৎসবের উদ্বোধন করবেন। শনিবার মহাকরণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সংক্রান্ত বৈঠকের শেষে মাটি উৎসবের কথা তিনি নিজেই তোলেন বলে সরকারি সূত্রের খবর। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, এই উৎসবের সঙ্গে গ্রামের মানুষকে সর্বতো ভাবে জড়িয়ে নিতে হবে।
মুখ্যমন্ত্রীর সেই বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে মেলার দায়িত্ব বর্তেছে কৃষি দফতরের ঘাড়ে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে বলা হয়েছে কৃষিজ বিপণন, উদ্যান পালন, প্রাণী সম্পদ উন্নয়ন ও জল সম্পদ উন্নয়ন দফতরকে। কৃষি দফতরের এক কর্তা বলেন, “গ্রামীণ জনজীবন কতটা মাটি-নির্ভর, এ বার আমরা নিজেদের মধ্যে বসে তার রূপরেখা তৈরি করব।”
কিন্তু একের-পর-এক মেলা-উৎসবের জন্য কোথা থেকে এত টাকা পাচ্ছে রাজ্য সরকার?
অর্থ দফতর সূত্রের খবর, তথ্য সংস্কৃতি ছাড়া আর কোনও দফতরে মেলা-খেলার বাজেট বরাদ্দ নেই। কিন্তু যুব কল্যাণ দফতর উন্নয়নের টাকা কেটে বিবেক উৎসবে খরচ করেছে ১২ কোটি টাকা। প্রায় আড়াই হাজার ক্লাবকে অর্থ সাহায্য করতে ক্রীড়া দফতরের গলে গিয়েছে ৬০ কোটি টাকার মতো। এবং তা খরচ হয়েছে ক্রীড়া উন্নতিতে বরাদ্দ অনুদান থেকেই। একই ভাবে, জঙ্গলমহল ও সুন্দরবনে প্রায় চার কোটি টাকা খরচ হয়েছে ফুটবল প্রতিযোগিতা করতে। এ ছাড়াও, বেঙ্গল লিডস, বেঙ্গল বিল্ডস, বিচ ফেস্টিভ্যাল, সবলা মেলা, মিলন মেলা ও পর্যটন উৎসব খাতে খরচ হয়েছে বেশ কয়েক কোটি টাকা।
কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) নির্দিষ্ট ভাবে কোনও কারণ না দেখালেও জানিয়েছে, চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ছ’মাসে সরকারের পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে খরচ বেড়েছে। অর্থ দফতরের কর্তার বক্তব্য, ধারা এখনও বজায় রয়েছে।
চলতি আর্থিক বছরে প্রথম ছ’মাস (সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) প্রাথমিক হিসেব (আনঅডিটেড প্রভিশনাল ফিগার) প্রকাশ করে সিএজি বলেছে, পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে রাজ্য তার আয়ের ৪৫.৫% খরচ করেছে, যার পরিমাণ ২৯,৭৩০ কোটি টাকা। অন্য দিকে, রাজস্ব আয়ের ২৮.৮% টাকা খরচ হয়েছে উন্নয়ন খাতে, যার পরিমাণ মাত্র ৫,৪২০ কোটি টাকা। সিএজি-র হিসেবে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজস্ব খাতে রাজ্যের আয় ২৬ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। অথচ ব্যয় হয়েছে ৩৬ হাজার ৪২ কোটি টাকা। এর সঙ্গে আরও কিছু আয়-ব্যয়ের হিসেব যোগ করলে মোট রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮,৮৬৪ কোটি টাকায়।
প্রশ্ন উঠেছে, কোথা থেকে ঘাটতি মেটাচ্ছে রাজ্য? অর্থ দফতরের কর্তারা জানান, ধার ছাড়া গতি নেই। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানাচ্ছে, ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে জানুয়ারি পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ৪৮ দিন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক থেকে অগ্রিম (ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স) নিয়ে খরচ চালাতে হয়েছে। একই সময়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ওভারড্রাফটে রাজ্য চলেছে ১৩ দিন। উৎসব চলছে নিজস্ব গতিতেই।
কী ভাবে সাজবে মাটি উৎসব? ওই কৃষি-কর্তা বলেন, “গ্রামের বহু মানুষ ছিটেবেড়ার ঘরে বাস করে। বেড়ার উপরে মাটির প্রলেপ থাকে। উৎসবে তেমনই মাটির বাড়ির মডেল রাখা হবে।” থাকবে লক্ষ্মীর পটের পসরাও। কেন? ওই কর্তার জবাব, “পট তো মাটি দিয়েই তৈরি হয়।” সে ভাবেই মাটি দিয়ে তৈরি লক্ষ্মীর ঘট, নানা পুতুল, ঘর সাজানোর সামগ্রী, সবই স্থান পাবে ওই উৎসবে। ওই কৃষি-কর্তা বলেন, “শহরে ঢেঁকি ছাঁটা চালের চাহিদা প্রচুর। কিন্তু কী ভাবে তা তৈরি হয়, অনেকেই জানেন না। মডেলের মাধ্যমে সে কথা জানতেই পারে আমজনতা।” কিন্তু যাঁদের জন্য উৎসব, সেই গ্রামের মানুষ তো ঢেঁকি ছাঁটা চাল জানেন? আর কথা বাড়াননি ওই কৃষি-কর্তা। মাটি উৎসবে মুখ্যমন্ত্রীর ‘জল ধরো, জল ভরো’ প্রকল্পের ‘সাফল্য’ জানান দিতে থাকতেই পারে একটা বড় পুকুর। তাতে মাছ ছাড়বেন জলসম্পদ দফতরের অফিসারেরা। ওই মাছ পালন করে কী ভাবে সংসার চালাচ্ছেন গ্রামের মানুষ, কী ভাবেই বা ওই জল সেচের মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে লাগোয়া জমিতে, তার ‘জীবন্ত’ মডেল থাকবে মাটি উৎসবে। প্রাণীসম্পদ উন্নয়ন দফতরের এক কর্তা বলেন, “গত এক বছরে গো-পালন, মুরগি পালন ও শূকর পালনে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গিয়েছে। কী ভাবে আরও উন্নতি ঘটানো যায়, মাটি উৎসবে সে কথাই আমরা পোস্টার-ছবি দিয়ে গ্রামের মানুষকে বোঝাব।” একই ভাবে সেমিনার, আলোচনাসভা ডেকে কৃষি দফতরও গ্রামের চাষিদের বোঝাবে, কেন জৈব সারের বেশি ব্যবহার হওয়া উচিত, কী ভাবেই বা অল্প জলে চাষ সম্ভব।
রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, বিভিন্ন দফতরের ট্যাবলো-পোস্টারে সাজবে মাটি উৎসব। মিলন মেলায় যে ভাবে স্টল সাজিয়েছিল সমস্ত দফতর, পানাগড়ও তেমন চেহারা নেবে। তবে এ ক্ষেত্রে সেই দফতরগুলোই স্টল দেবে, যাদের সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতির যোগ আছে।
মা-মাটি-মানুষ সরকারের এই উৎসব যে পঞ্চায়েত ভোটকে সামনে রেখেই, মানছেন মহাকরণের কর্তারা।
|
এ বার মাটি উৎসব পানাগড়ে |
বাজে খরচের ধাক্কা |
এপ্রিল ২০১২ থেকে জানুয়ারি ২০১৩ |
• পাঁচ খেপে ১৩ দিন ওভারড্রাফট নেওয়া হয়েছে
• মোট ৪৮ দিন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অগ্রিমে সচল কোষাগার
• বাজার থেকে নেওয়া ঋণ ১৭,৩০০ কোটি টাকা |
সূত্র: রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া
|
এপ্রিল ২০১২ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১২ |
রাজস্ব আদায়: ২৬,২২৭*
ব্যয়: ৩৬,০৪২*
রাজস্ব ঘাটতি: ৮,৮৬৪* |
* কোটি টাকা
সূত্র: সিএজি |
|