রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
সুমনামি
বেশির ভাগ মানুষের জীবনেই মায়ের মুখে শোনা কোনও গান বা নিদেন পক্ষে গুনগুনানি সম্ভবত তাদের প্রথম গান শোনার অভিজ্ঞতা। সব মায়ের গলায় যে সুর থাকে তা নয়। কিন্তু সকলেই চেষ্টা করেন তাঁদের বাচ্চাদের গান গেয়ে বা গুনগুন করে ঘুম পাড়াতে। এমনিতে যিনি কোনও দিনই গান করেননি, তিনিও তাঁর সন্তানকে একান্তে গান গেয়ে শোনান। এই অভিজ্ঞতা, আমার ধারণা, অনেকেরই আছে। সেই গানে বা গুঞ্জনে সংগীতের শর্ত-মানা সুর না থাকলেও, যা থাকে তা অবশ্যই এক ধরনের সুর।
ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ ছবির একেবারে শেষে ছোট্ট একটি ছেলে গেয়ে উঠছে তার মায়ের কাছে শুনে-শেখা গান ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরির খেলা’। ছেলেটির মা দস্তুরমতো গান গাইতেন। ছেলেটির কিন্তু, যা শোনা যাচ্ছে, গানের গলা নেই, গলায় সুর নেই। অথচ তার মনে গান যখন আসছে, সে তখন গেয়ে উঠছে তার মায়ের শেখানো গানটিই। সংগীতের নিরিখে সুরে গাওয়ার দায় তার নেই। সে ‘গান’ গেয়ে উঠছে। রবীন্দ্রনাথের দেওয়া সুর হুবহু মেনে নয়। সেই সুরের ধাঁচা মেনে, গানের চলন মেনে, ছন্দ মেনে। এ ছেলে গলায় সুর নিয়ে জন্মায়নি, কিন্তু ছন্দের বোধ সে নিয়ে জন্মেছে বইকি। বহু ছেলেমেয়ের মধ্যেই এটা দেখা যায়। এবং তাদের বাবা-মায়েরা বাঙালি হলে সেই না-সুর-হ্যাঁ-ছন্দ নবীনদের গান শিখতে পাঠান। দরকার হলে জোর করে। তার ফল যা দাঁড়ায় তা এই বেচারি ছেলেমেয়েরাই জানেন।
‘সুবর্ণরেখা’ ছবিটির শেষ দিকে মা-বাপ হারা, মর্মান্তিক এক ট্র্যাজেডির সন্তান এই ছেলেটি ওই গান ওই ভাবে না গেয়ে নিখুঁত সুরে গেয়ে উঠলে ফল কী দাঁড়াত, তা এখনকার যে-কোনও সহজলভ্য ভিডিয়ো এডিটিং সফটওয়্যারের সাহায্যে যাচাই করে নেওয়া যেতে পারে। ওই দৃশ্যটিকে ডিভিডি থেকে সফটওয়্যারের ভিডিয়ো ট্র্যাকে ফেলা হোক। পৃথক একটি অডিয়ো ট্র্যাকে সুগায়ক কোনও বালককে দিয়ে (বা বালিকা, মায় জনপ্রিয় কোনও গায়িকাকে দিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রে যা আকছার ঘটেছে, ঘটে চলেছে) ওই গানটির প্রথম অন্তরা অবধি গাইয়ে রেকর্ড করে নেওয়া হোক। এই বার মূল ভিডিয়ো ট্র্যাকের সঙ্গে যে মূল অডিয়ো ট্র্যাকটি আছে, সেটি নীরব করে দিয়ে ভিডিয়োর সঙ্গে নতুন নিখুঁত গাওয়াটি শোনা যাক। আর তার পর শোনা যাক নতুন গাওয়া ট্র্যাকটি নীরব করে মূল ভিডিয়োর সঙ্গে মূল অডিয়ো ট্র্যাকটি। রসিকের মন হায়-হায় করে উঠবে ব্যাকরণগতভাবে বেসুর গাওয়াটি শুনে। আমি, যেমন, ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেছিলাম।
ছবি: সুমন চৌধুরী
এতটা ছিঁচকাঁদুনে না হলেও বেশির ভাগ স্বাভাবিক মানুষের চোখে এক ধরনের অস্বস্তি দেখা দেওয়া বিচিত্র নয়। এটা কি বেসুর? নিক্তি-মাপা সংগীতের নিয়মে হ্যাঁ, বেসুর। কিন্তু অনেক কাল আগে সংগীতাচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাহানা দেবী যা বলেছিলেন, সেই ‘সুরের ভেতরকার সুর’-এর নিয়মে এটা ওই ছবির প্রেক্ষিতে নিছক বেসুর নয়। ঘটনাপরম্পরায়, নানান নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিটির শেষ লগ্নে যে-দৃশ্য আমরা দেখছি, তার নিরিখে এ হল, আমার মতে, পবিত্র বেসুর। অনেক মায়ের একান্তে গাওয়া ঘুমপাড়ানি গানে বা আদরের গুনগুনানিতে এই পবিত্র বেসুরই থাকে, যার সমকক্ষ পৃথিবীর সেরা সুরগুলিও কিছুতেই হতে পারবে না।
ছোট্ট ছেলেটির গানের রেশ থেকে যখন একাধিক বাজনা সহযোগে রবীন্দ্রনাথের ‘ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির খেলা’ গানটির সুর নিখুঁত ভাবে বেজে উঠল, তখনই বরং ‘সুরের ভেতরকার সুর’-এর স্বরাজ এক ধাক্কায় ভেঙে পড়ল, কায়েম হতে চাইল প্রতিষ্ঠান-সমর্থিত সংগীত। মায়ের গাওয়া গানের আলোছায়া-মাখা ছোট একটি ছেলের জীবন ও স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসা গানকে ধ্বংস করে দিতে চাইল এবারে-কারা-পঁচিশে-বৈশাখে-রবীন্দ্রসদনে-গান-গাইতে-পারবে-তা-যাচাই-করার সরকারি কমিটি-অনুমোদিত রবীন্দ্র সুর।
‘সুবর্ণরেখা’ ছবিটি দেখার পর যদি ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে দেখা হত, আমি সত্যাগ্রহ করতাম তাঁর সামনে। আমার দাবি থাকত একটাই: ‘সুবর্ণরেখা’ উনি আবার এডিট করে শেষের আনুষ্ঠানিক যন্ত্রসংগীতটা বাদ দিয়ে দিন। ছেলেটির গাওয়া পবিত্র বেসুরের রেশ নিয়ে শেষ হোক সব।
দুনিয়ার অনেক মায়ের গলাতেই হয়তো নিখুঁত সুর নেই। সবে-হওয়া সন্তানকে বুকে নিয়ে মায়ের মনের ভেতরে কী যে হয়, এক জন পুরুষ হিসেবে তা আমি কল্পনাও করতে পারব না। তবু, বাচ্চা-কোলে মা আপন মনে আছেন এই দৃশ্য আরও অনেকের মতো আমিও দেখেছি। কোনও কোনও মুহূর্তে আমার মনে হয়েছে, তাঁর মনে সুর আসছে, গান আসছে। চেয়ে আছেন তিনি তাঁর কোলের সন্তানের দিকে: তাঁর দৃষ্টিটাই সুর। তাঁর মুখে যে ভাবগুলি খেলে যাচ্ছে দক্ষ হাতে বাঁধা স্বরমণ্ডলের ওপর যেন হাওয়া বয়ে গেল, কতকগুলি তার বেজে উঠল অস্ফুটে। কিন্তু এ তো উপমা। এ দিয়ে একটা-দুটো গান বানানো যেতে পারে। তাতে ধ্বনি থাকবেই থাকবে। খোদ বিষয়টি কিন্তু ধ্বনিহীন। আর ধ্বনিই যদি না থাকে তো সুর-তাল কোথায়!
একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, সদ্যোজাত শিশুর সঙ্গে মা যখন খ্যালেন বা তাকে ভোলান, মুখ দিয়ে নানান আওয়াজ করেন তিনি। কোনও আওয়াজ একটু টেনে-টেনে। কোনও কোনওটা আবার ছোট, একটু ধাক্কা দিয়ে-দিয়ে। একই আওয়াজ কখনও একটু লম্বা, পরের মুহূর্তেই আবার ছোট। একই ধ্বনি মা বা দিদিমা-ঠাকুমাই শুধু নন, বাবা’কে বা অন্য পুরুষদেরও করতে শোনা যায়। তেমনই ‘এ’, ‘ঈ’, ‘ও’, ‘ঊ’ স্বরবর্ণগুলির সঙ্গে ‘ম’, ‘ল’, ‘ত’, ‘দ’, ‘র’, ‘ন’ এই ব্যঞ্জনবর্ণগুলিও সাবলীল ভাবে বেরিয়ে আসে বড়দের মুখ থেকে শিশুদের সামনে, খেলার ছলে। শিশুরাও এই ধরনের আওয়াজ করে থাকে কথা বলতে শেখার আগে। এমন কি হতে পারে যে, আমাদের দেশের ধ্রুপদী কণ্ঠসংগীতে ‘তারানা’ নামে যে আঙ্গিকটি চালু, তার মধ্যেও লুকিয়ে আছে এই ‘ভাষা’? অর্থাৎ, কথা দিয়ে তৈরি বন্দিশের অন্য দিকে শুধু ‘তা’, ‘নু’, ‘লি’, ‘তানা’, ‘তেরে’, ‘দেরে’, ‘নোম’, ‘তোম’, ‘দিম’ এই সব ধ্বনি মিশিয়ে এক ধরনের বন্দিশই তৈরি করে নেওয়া হয়, যার কোনও নির্দিষ্ট মানে নেই, আছে নানান ধ্বনি নিয়ে খেলা।
পাশ্চাত্য সংগীতে একটি স্বরকে তার পাশের স্বরের গায়ে আলতো লাগিয়ে বাজানোর যে ‘লেগাতো’ আঙ্গিক বা প্রতিটি স্বরে আলাদা-আলাদা ঘা দিয়ে কাটা-কাটা করে বাজানোর যে ‘স্তাকাতো’ আঙ্গিক, আমাদের তারানাতেও সেগুলি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এবং ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে খেলার ছলে যে-ধ্বনিগুলি বড়রা মুখ দিয়ে বের করেন সেগুলিও। কী আশ্চর্য, এই আঙ্গিকগুলিতেই, যদিও অনির্দিষ্ট ভাবে। এমন কি হতে পারে যে, কথা বলতে শেখার আগে বাচ্চারা যে ধরনের আওয়াজ করে থাকে এবং বড়রা যেগুলি অনুকরণ করতে চেষ্টা করেন আদরের ভঙ্গিতে, কণ্ঠসংগীতের আঙ্গিকেও সেগুলির কিছু কিছু প্রয়োগ ঘটেছে হয়তো কোনও সচেতন ইচ্ছে ছাড়াই, যুগ যুগ ধরে?
পণ্ডিতরা হয়তো বলবেন, না হে, তারানার ওই ধ্বনিগুলির আরও গভীর মর্ম আছে। একটি শিশু ও বয়স্ক মানুষের মধ্যে ছোট-বড় ধ্বনি বিনিময়ের খেলা থেকে পবিত্র বেসুর ও ছন্দের যে দুনিয়াটা সৃষ্টি হয়, তার যেন কোনও মর্ম নেই!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.