|
|
|
|
সুভাষের তিন চালে ফকির মর্গ্যান |
রতন চক্রবর্তী • কলকাতা |
চার্চিল ব্রাদার্স ৩ (হেনরি ২, আক্রাম ১)
ইস্টবেঙ্গল ০ |
ইটের বদলে পাটকেল!
তিন গোলের বদলা পাল্টা তিন!
লাল-হলুদ গ্যালারি থেকে দেখানো জুতোর জবাব বিধ্বংসী পারফরম্যান্স!
ট্রেভর জেমস মর্গ্যানকে আই লিগ রিং-এর বাইরে পাঠিয়ে সুভাষ ভৌমিক যখন টিম বাসে উঠে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছেন, তখন তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, বিশ্বের সবচেয়ে তৃপ্ত মানুষ।
তৃপ্তির প্রথম কারণ যদি হয় গোয়ায় মর্গ্যানের কাছে হারের বদলা, তা হলে দ্বিতীয় কারণ বাংলার ক্লাবের আই লিগ জয়ের ইচ্ছার কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেওয়া।
পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মর্গ্যানের তুলনা হচ্ছে শুনে মাস খানেক আগে গোয়া থেকে ফোনে কটাক্ষ করেছিলেন সুভাষ। ঝাঁঝালো মন্তব্যটা এখনও কানে বাজে। “আগে আমার বা সুব্রত ভট্টাচার্যর আই লিগ জেতার পারফরম্যান্সটা মর্গ্যান স্পর্শ করুক, তার পর গুরুর সঙ্গে তুলনা টানবেন।”
শনিবার ইস্টবেঙ্গলকে হারানোর পর চার্চিল কোচ অবশ্য মর্গ্যান সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করেননি। মুখে হাজার ওয়াটের আলো ছড়িয়ে হাসতে হাসতে উঠে বসেছেন টিম বাসে। সুভাষের না-বলা কথা বলে দিয়েছেন তাঁর অধুনা অভিন্নহৃদয় ‘বন্ধু’ সুব্রত ভট্টাচার্য। প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন মর্গ্যানের পারফরম্যান্স নিয়েই। “আরে আমাদের এখানে বিদেশি কোচ দেখলেই তো কর্তাদের লালা ঝরে। দু’চারটে ম্যাচ জিতলেই হইচই। তিন বছরে মর্গ্যান করেছেটা কী? দু’টো ফেড কাপ। সে তো অনেকেই পেয়েছে। আই লিগ জিতেছে?” |
পদতলে |
|
যুবভারতীতে মুখ থুবড়ে পড়লেন চিডি। ইস্টবেঙ্গলও। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস |
যাঁর সম্পর্কে এ সব বলা, সাংবাদিক সম্মেলনে এসে সেই ব্রিটিশ কোচ মনে হল কেঁদেই ফেলবেন! হাসিখুশি মুখটা উধাও। কোনও শববাহী দলের সদস্য মনে হচ্ছিল তাঁকে। যন্ত্রণাবিদ্ধ, ক্লান্ত, হতাশ। মর্গ্যানের মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আর কোনও সম্ভাবনা নেই। ভারতে আমার কোচিং জীবনের জঘন্যতম ম্যাচ। বলতে পারেন মিস ম্যাচ। খেলতেই পারিনি আমরা।”
ট্রেভর মর্গ্যান বনাম সুভাষ ভৌমিক মানেই, দুই ধুরন্ধর কোচের স্ট্র্যাটেজির ধুন্ধুমার দ্বৈরথ। ট্যাকটিক্সের নিখুঁত অঙ্ক। পুরো মাঠকে দাবার বোর্ড করে চাল, পাল্টা চালের খেলায় বাজিমাতের মরিয়া চেষ্টা।
কিন্তু কোথায় কী? যুবভারতী তো সপ্তাহ শেষে দেখল বিশ্বনাথন আনন্দ বনাম দীপাঞ্জন দাসের মতো অসম লড়াই! যেখানে যুদ্ধ নেই, আছে নির্বাক আত্মসমর্পণ। চার্চিলের সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল তা-ই করল এ দিন।
সুভাষের মাস্ট্রার স্ট্রোক ছিল তিনটি। ১) বেটোকে উইথড্রয়াল ফরোয়ার্ড করে দিয়ে মাঝমাঠের দখলদারি নিয়ে নেওয়া। দুই) চিডি আর পেনকে নির্বিষ করার জন্য লেবাননের বিলাল আর স্বদেশি লেনিকে ব্যবহার। তিন) বিপক্ষের দুই উইং অকেজো করতে নিজের দুই সিনিয়র স্টিভন ডায়াস আর তোম্বা সিংহকে পাল্টা যুদ্ধে পাঠানো।
জাতীয় দল থেকে বহু দিন বাতিল। ক্লাব টিমেও মাঝেমধ্যে জায়গা হচ্ছিল না স্টিভন ডায়াসের। এ দিন তিনিই ম্যাচের সেরা। হেনরির দু’টো গোলের পাস তাঁর, আক্রমের গোলের ফ্রিকিকের পাসটাও তো স্টিভনেরই। সর্পিল গতি আর মাপা পাসে লাল-হলুদ রক্ষণকে কাঁদিয়ে ছাড়লেন স্টিভন। আর চৌত্রিশের বেটো? কী কমিটমেন্ট! অর্ধেক মাঠ জুড়ে যাঁর দাপাদাপি মনে করাচ্ছিল ২০০৩-০৪-এর মাইক ওকোরোকে। ইস্টবেঙ্গলের কোচ থাকার সময় ভাইচুং-জুনিয়রের পিছনে ওকোরোকে যে ভাবে ব্যবহার করতেন সুভাষ, সে ভাবেই এ দিন ব্যবহার করলেন বেটোকে। |
কেন খেতাব দূর অস্ৎ কলকাতার |
• চার্চিল, ডেম্পো, পুণে এফসি ম্যাচ খেলেছে কম। সেখানে ইস্টবেঙ্গল এবং ইউনাইটেড খেলেছে অনেক বেশি।
• ইস্টবেঙ্গলের বাকি নয় ম্যাচে কঠিন প্রতিপক্ষ: ডেম্পো, ইউনাইটেড স্পোর্টস, পুণে এফসি, মোহনবাগান। ইউনাইটেড স্পোর্টসকে খেলতে হবে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, চার্চিল ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে।
• ইস্টবেঙ্গল এবং ইউনাইটেডকে লড়াইয়ে ফিরতে হলে নিজেদের ম্যাচ জিতলেই হবে না, চার্চিল-পুণের মতো দলগুলিকে হারতেও হবে অন্যান্য ম্যাচে। নির্ভর করতে হবে লিগ টেবলে ওঠা-নামার অনেক যদি ও কিন্তুর উপর। |
|
জাতীয় লিগের নাম বদলে আই লিগ হওয়ার পর থেকে তা ঢোকেনি ফুটবলের শহর কলকাতায়।
শেষ বার জাতীয় লিগ এসেছিল ২০০৩-০৪-এ। মরসুমে। |
|
|
আই লিগে প্রথম পাঁচ |
চার্চিল ম্যাচ ১৫ জয় ১২ পয়েন্ট ৩৭ |
ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ ১৭ জয় ১০ পয়েন্ট ৩৩ |
ডেম্পো ম্যাচ ১৬ জয় ১০ পয়েন্ট ৩৩ |
পুণে এফসি ম্যাচ ১৪ জয় ৯ পয়েন্ট ২৯ |
ইউনাইটেড স্পোর্টস ম্যাচ ১৭ জয় ৮ পয়েন্ট ২৬ |
|
স্টিভন-বেটোর দৌরাত্ম্যে ম্যাচ শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই মাঝমাঠ পকেটে পুরে নিয়েছিল গোয়ার ক্লাব। কিন্তু কোন জাদুকাঠির ছোঁয়ায় দুই চার্চিল মিডিওর ‘বৃদ্ধ’ থেকে ‘যুবক’ হয়ে ওঠা? সহজ উত্তরফিটনেস এবং ফিটনেস। চার্চিল টিমটার শারীরিক সক্ষমতা সত্যিই ঈর্ষা করার মতো। এখানেও কিছুটা মার খেল মর্গ্যানের টিম। সুভাষ টিম নামিয়েছিলেন ৪-৪-১-১ ফর্মেশনে। আক্রমণ আর চাপের মুখে যা ভাঙা গড়া হচ্ছিল। লোক বাড়ানো হচ্ছিল পরিস্থিতি বুঝে। সুভাষের এই স্ট্র্যাটেজির গোলকধাঁধায় পড়ে সারাক্ষণ অন্ধকার হাতড়ে বেড়ালেন পেন-রবিন-মেহতাবরা।
বেটোকে আটকাতে মেহতাবকে লাগিয়েছিলেন মর্গ্যান। হেনরির জন্য পালা করে মার্কার রাখা হয়েছিল দুই স্টপার ওপারা আর অর্ণবকে। তিন জনেই চূড়ান্ত ব্যর্থ। লালরিন্দিকা আর কেভিন লোবোকে শুরুতে নামিয়ে মর্গ্যান যে চমক দিতে চেয়েছিলেন, সেটাও মুখ থুবড়ে পড়ল চার্চিল রক্ষণ অঙ্ক কষে খেলায়। নোট বই জানাচ্ছে, পুরো ম্যাচে মাত্র একটাই গোল করার সুযোগ পেয়েছিল মর্গ্যানের টিম।
চার্চিলের টিম বাস স্টেডিয়াম ছেড়ে যাওয়ার সময় লাল-হলুদ জনতার উচ্ছ্বাস দেখে হাত নাড়লেন সুভাষ। আর চতুর্থ বিদেশি বরিসিচকে পাশে বসিয়ে মর্গ্যানের গাড়ি যখন রওনা দিল, জুটল শুধুই গালাগাল। কোচেদের জীবন এ রকমইআজ রাজা তো কাল ফকির!
এ বারও আই লিগে ফকিরই রয়ে গেলেন ট্রেভর জেমস মর্গ্যান, তাঁর ইস্টবেঙ্গলও।
|
ইস্টবেঙ্গল: অভিজিৎ, খাবরা, অর্ণব, ওপারা, রবার্ট (সৌমিক), কেভিন, পেন, মেহতাব, লালরিন্দিকা (নওবা), চিডি, রবিন (মননদীপ)। |
|
|
|
|
|