|
|
|
|
রাহুলই সেনাপতি |
পরম্পরা মেনেই নেতৃত্বের সিলমোহর |
শঙ্খদীপ দাস • জয়পুর |
বজায় রইল পরম্পরা।
ঠিক যে ভাবে ইন্দিরা গাঁধী প্রথমে সঞ্জয়, পরে রাজীবকে এনেছিলেন শীর্ষ নেতৃত্বে, সে ভাবেই উঠে এলেন গাঁধী পরিবারের নতুন প্রজন্ম রাহুল। ঘরোয়া ভাবে বেশ কিছু দিন ধরেই দলের ‘নম্বর-টু’ ছিলেন তিনি।
এ বারের চিন্তন শিবিরে সনিয়া গাঁধী-মনমোহন সিংহের সঙ্গে সমান গুরুত্বে আলোচনা করেছেন নেতাদের সঙ্গে। এর মধ্যে তাঁকে আনুষ্ঠানিক ভাবে বড় দায়িত্বে আনার দাবি তো ছিলই। চিন্তন শিবির শেষে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত বৈঠকে সেটাই মেনে নিল হাইকম্যান্ড। রাহুলকে সহ-সভাপতি করে আনুষ্ঠানিক সিলমোহর দেওয়া হল দলের এত দিনের সেই দাবিতে।
বিজেপি এর মধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছে লোকসভা ভোটে তাদের সেনাপতি কে হবেন। নিতিন গডকড়ীকে দ্বিতীয় বার সভাপতি করার সঙ্গে সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হয়ে ওঠা অনিবার্য হয়ে পড়েছে বলেই মত রাজনীতির কারবারিদের। সেই সঙ্গে বিজেপি প্রচার শুরু করে, রাহুল সরাসরি নেতৃত্বে আসতে নারাজ। না হলে দলে কার্যত দ্বিতীয় হয়েও তাঁর পদ নিতে অনীহা কেন?
আজ রাহুলকে আনুষ্ঠানিক ভাবে দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট বা সহ-সভাপতি পদে বসিয়ে বিজেপির এই প্রচারের উপযুক্ত জবাব দিলেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। বস্তুত, বিরোধীদের অভিযোগ খারিজ করে দিয়ে নবীন প্রজন্মকে নতুন নেতা দিল কংগ্রেস। কংগ্রেসের এই চালের জবাব বিজেপি কী ভাবে দেয়, সেটাই দেখার।
আলোচনায় উঠে এসেছে গাঁধী পরিবারের পরম্পরার বিষয়টিও। সঞ্জয় বা রাজীব গাঁধীর বেলাতেও তাঁদের নেতৃত্বে নিয়ে আসার দাবি প্রথমে ওঠে দলের মধ্যে থেকে। বিভিন্ন রাজ্য বা প্রদেশ কমিটি থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় স্তরের নেতারাও এই দাবি তুলতে থাকেন। রাহুলের বেলাতেও একই ভাবে দলের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দাবি উঠছে। শুধু দলের নবীন প্রজন্মই নয়, দাবি তুলতে শুরু করেছেন প্রবীণ নেতারাও। তবে বিষয়টি নিয়ে রাহুল এত দিন চুপ করে ছিলেন। সনিয়ার বক্তব্য ছিল, বিষয়টি রাহুলের উপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক করে রাহুলকে সাংগঠনিক দায়িত্বে আনা হয়।
ঘরোয়া ভাবে তাঁকে কার্যত দলের দু-নম্বর হিসেবে মেনেও নেওয়া হয় সম্প্রতি। ২০১৪ লোকসভা ভোটে কার্যত সেনাপতির দায়িত্ব রাহুলই পালন করছিলেন। বাকি ছিল আনুষ্ঠানিক সিলমোহরের।
সনিয়ার পরে রাহুল দলের দায়িত্ব নেবেন এই ঘটনায় অভূতপূর্ব কিছু দেখছে না বিজেপি। বরং তাঁদের কেউ কেউ পরিবারতন্ত্রের প্রসঙ্গ টেনে কংগ্রেসকে বিঁধতে চেয়েছেন। কংগ্রেস নেতারা অবশ্য এই অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, যে ভাবে দীর্ঘদিন ধরে দলের মধ্যেই বিভিন্ন মহল থেকে রাহুলকে নেতৃত্বে চেয়ে দাবি ও চাপ বাড়ছিল, তাতে এই সিদ্ধান্তকে মোটেও ‘পরিবারতন্ত্রের শাসন’ বলা যাবে না। বরং কংগ্রেস নেতারা বলছেন, যত বারই গাঁধী পরিবারের কেউ দলের হাল ধরেছেন, অন্তর্কলহ ঝেড়ে ফেলে দল একজোট হয়েছে। রাহুল দায়িত্ব নিলেও দল একজোটেই এগোবে। |
|
প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন। জয়পুরে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে। ছবি: পি টি আই |
এ দিন সকাল থেকেই রাহুলকে নিয়ে চূড়ান্ত উৎসাহ ছিল দলের সর্বস্তরে। সকালে চিন্তন শিবিরে এসে অনেক নেতাকেই এই সংক্রান্ত প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল।
রাজীব শুক্ল, শ্রীপ্রকাশ জয়সওয়াল, মল্লিকার্জুন খারগের মতো নেতারা সকলেই বলেন, তাঁরাও রাহুলকেই নেতৃত্বে চাইছেন।
তবে বিষয়টি যে রাহুলের নিজের উপরেই নির্ভর করছিল, তা স্পষ্ট করে দেন রাহুল-ঘনিষ্ঠ নেতা দিগ্বিজয় সিংহ। দুপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনায় তিনি বলেছিলেন, “রাহুল ইতিমধ্যেই সংগঠনে বৃহত্তর দায়িত্ব পালন করছেন। লোকসভা ভোটের আগে তিনি যে কংগ্রেসের মুখ হবেন, তা নিয়েও সংশয় নেই। তিনি কোনও দায়িত্ব বা পদ নেবেন কি না, সেটা তাঁর ওপরই ছেড়ে দেওয়া হোক।” দিগ্বিজয় যখন মিডিয়া সেন্টারে বসে এ কথা বলছেন, তখন সেখানে বিরাট টিভি স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে, ১০ জনপথের সামনে থিকথিকে ভিড়।
চিন্তন শিবির শেষ হওয়ার পরে নির্ধারিত সময়েরও এক ঘণ্টা দেরিতে বসে সিডব্লিউসি-র বর্ধিত বৈঠক। সেখানে প্রথমেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি সহ-সভাপতি হিসেবে রাহুলের নাম প্রস্তাব করেন। সঙ্গে সঙ্গে বাকি সদস্যরা টেবিল চাপড়ে তা সমর্থন করেন। রাহুল উঠে বলেন, “আমি এই দায়িত্ব গ্রহণ করছি।” পরে রাহুল ছোট্ট বক্তৃতায় বলেন, “আমি দেশ ঘুরে দেখেছি। দেশকে জেনেছি। এই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একসঙ্গে কাজ করলে আমাদের দল দেশকে বদলে দিতে পারে।”
তত ক্ষণে ১০ জনপথের বাইরে তো বটেই, জয়পুরেও শুরু হয়ে গিয়েছে উৎসব। চার দিকে বাজির শব্দে কান পাতা দায়। রথও বের করে যুব কংগ্রেস। উৎসবের খবর আসছে রাহুলের নির্বাচনী কেন্দ্র অমেঠি এবং সনিয়ার নির্বাচনী কেন্দ্র রায়বরেলী থেকে। কংগ্রেস নেতারা বলছেন, চিন্তন বৈঠক মানেই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। শিমলায় দ্বিতীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, জোট রাজনীতিতে পা রাখবে দল। আর এ দিন জয়পুরে রাহুলকে সহ-সভাপতি করার সিদ্ধান্ত।
ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের মধ্যেই রাহুলকে অভিনন্দন জানাতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। ফুলের তোড়া এবং মালা নিয়ে একে একে এগিয়ে আসেন দলীয় নেতারা। মনমোহনও এসে জড়িয়ে ধরেন। পরে বৈঠকের শেষে দলের মুখপাত্র জনার্দন দ্বিবেদী বাইরে এসে সাংবাদিকদের সামনে এই সংক্রান্ত ঘোষণাটি করেন। এই সব ঘটনা দেখেশুনে রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, প্রস্তুতিটা ছিলই। ঠিকই করা ছিল, এ দিন রাহুলকে দলের সহ-সভাপতি পদে আনা হবে। বাকি যা দেখছে সকলে, সেটা হয়েছে চিত্রনাট্য মেনেই।
কংগ্রেসের গঠনতন্ত্রে সহ-সভাপতি পদটি নেই। তবে কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যাঁরা ওয়াকিবহাল, তাঁরা বলছেন, দলের সভাপতির ক্ষমতা অসীম। তিনি ইচ্ছে করলে এই পদ তৈরি করে কাউকে দায়িত্ব দিতে পারেন। রাহুলের আগে দু’জন সহ-সভাপতি হয়েছিলেন। রাজীবের আমলে অর্জুন সিংহ এবং সীতারাম কেসরী যখন সভাপতি ছিলেন তখন জিতেন্দ্র প্রসাদ। এ বারে রাহুলকে পদ দেওয়ার ব্যাপারে একাধিক প্রস্তাব ঘোরাফেরা করছিল দলের মধ্যে। শুধু সহ-সভাপতি নয়, তাঁকে দলের সেক্রেটারি জেনারেল বা মহাসচিব অথবা কার্যকরী সভাপতি করারও প্রস্তাব এসেছিল। অতীতে দলের কার্যকরী সভাপতি হয়েছিলেন কমলাপতি ত্রিপাঠী, সেক্রেটারি জেনারেল হয়েছিলেন হেমবতী নন্দন বহুগুণা। কিন্তু রাহুলকে এর কোনও একটি পদে আনলে সনিয়া গাঁধীর কর্তৃত্বকেই কার্যত চ্যালেঞ্জ জানানো হবে বলে মনে করছিলেন দলীয় নেতৃত্বের বড় একটি অংশ। দলীয় সূত্রের খবর, শেষ পর্যন্ত তাই ঠিক হয়, তাঁকে সহ-সভাপতিই করা হবে।
বস্তুত, এ বারের চিন্তন বৈঠক ছিল রাহুলেরই বৈঠক। দলের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রস্তাবে তাঁর মতকে গুরুত্ব দিয়ে সংস্কারও করতে চলেছে দল। পাশাপাশি দলের সাংগঠনিক পুনর্গঠনের কাজে তিনি মা সনিয়াকে এ বার আরও বেশি করে সাহায্য করবেন বলে জানালেন দিগ্বিজয়। তবে সকলে তাকিয়ে আছেন আগামিকাল রাহুলের বক্তৃতার দিকে। চিন্তন শিবিরের শেষে কাল কংগ্রেসের প্রকাশ্য সমাবেশ। সেখানে সংস্কারপন্থী নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধি রাহুল কী বলেন, তাঁর মায়ের উল্লিখিত ‘নবীন ভারত’ গড়ার কাজে যে সব চ্যালেঞ্জ আসতে পারে, তা মোকাবিলায় কী পথ দেখান, সে জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে রয়েছেন সকলে। |
|
|
|
|
|