অষ্টমীর রাতে আচমকাই পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছিলেন তিনি। তার পর চার মাস কাটতে না-কাটতে বইমেলার আগেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বইগুলিকে কপিরাইট মেনে ‘স্ট্রিমলাইন’ করার কাজ শুরু হয়ে গেল।
নীললোহিত, সনাতন পাঠক ও নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে লেখা সুনীলের কিছু বই আজকাল মাথা খুঁড়ে মরলেও মেলে না। নিজের কোন লেখা থেকে ভবিষ্যতে কাকে সিনেমা বা নাটক করার অনুমতি দিয়েছেন, তারও ঠিকঠাক সন্ধান মেলা ভার। “সম্প্রতি কেরলের তিন প্রযোজক জানালেন, বাবা নাকি তাঁদের ‘স্বর্গের নীচে মানুষ’ উপন্যাসের চিত্রস্বত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। কোনও প্রকাশক বলছেন, বাবা অমুক বইয়ের স্বত্ব তাঁদের দিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে তথ্যগুলি জানতে চাইছি,” আমেরিকা থেকে ফোনে জানালেন সুনীল-পুত্র শৌভিক। তিনি ও তাঁর মা স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় সম্প্রতি সলিসিটর ফার্মের নোটিসও জারি করেছেন। সুনীল কাউকে যদি গল্প, কবিতা, সিনেমা, নাটক সংক্রান্ত কোনও স্বত্ব দিয়ে থাকেন, তাঁরা যেন আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে প্রমাণপত্র জমা দেন।
প্রমাণপত্র? মৃত্যুর আগে সুনীল মৌখিক ভাবে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়কে তাঁর ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ উপন্যাসের নাট্যস্বত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। স্বাতী সে কথা জানতেন। ফলে সুনীলের মৃত্যুর পরেও চুক্তি করতে দেবেশের অসুবিধা হয়নি। উপন্যাসের নায়ক শিশির ভাদুড়ীর চরিত্রে এক বর্ষীয়ান অভিনেতাকে নিয়ে আসার জন্য এখন আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। কিন্তু লিখিত অনুমতি ছাড়াই গত ৩১ ডিসেম্বর সুনীলের গল্প নিয়ে ‘সাঁকো’ নামের একটি একাঙ্ক নামিয়েছিলেন দেবেশ। “পারমিশনটা স্বাতীদি ফিরলে নেব,” বলছেন তিনি। স্বাতী এখন পুত্রের কাছে, আমেরিকায়।
এই মৌখিক অনুমতিটাই বাংলা বাজারে চালু টাকা। বছর কয়েক আগে সুনীলের ‘সত্যি রাজপুত্র’ গল্প নিয়ে নান্দীকার নাটক নামিয়েছিল। তাদের নতুন প্রযোজনা ‘হৃদমাঝারে’ নাটকেও ব্যবহৃত হয়েছে সুনীলের কবিতা ‘ভ্রূপল্লবে ডাক দিলে চন্দনের বনে।’ দু’টি ক্ষেত্রেই লেখক এবং নাট্যকারের মধ্যে লিখিত চুক্তি নেই। “এখানে কপিরাইট, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটের অত বাঁধাবাঁধি নেই। ‘সত্যি রাজপুত্র’ নাটকটা সুনীল দেখে গিয়েছিলেন, প্রশংসাও করেছিলেন,” বলছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত।
নীললোহিত নিজেও অত বাঁধাবাঁধির মধ্যে যেতেন না। বাংলা সাহিত্যের উত্তমকুমার, ফলে ছোটখাটো অনেক প্রকাশককেই বৈতরণী পার করাতে হত তাঁকে। লিটল ম্যাগ থেকে কলেজ স্ট্রিটের নতুন প্রকাশক, সকলেরই আবদার থাকত, তাঁর একটি বই। এবং সুনীলও উদার ভঙ্গিতে অনুমতি দিতেন। কয়েক বছর পর প্রকাশক পাততাড়ি গোটালে সেই বইও ‘আউট অফ প্রিন্ট’ হয়ে যেত। ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড’-এর গত বছরের ডিরেক্টরি জানাচ্ছে, উপন্যাসসমগ্র, সেরা গল্প, কবিতাসমগ্র ইত্যাদি ধরে বাজারে সুনীলের ৩৪৯টি বই রয়েছে। নীললোহিতের রয়েছে ৩০টি ‘টাইট্ল’। নীল উপাধ্যায় এবং সনাতন পাঠকের কোনও বই নেই।
বইয়েরা এ ভাবেই হারিয়ে যায়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় মনে করতে পারেন, নতুন এক প্রকাশক ছাপার জন্য তাঁর ও সুনীলের থেকে বই নেন। কিন্তু সেই প্রকাশনা অচিরে লালবাতি জ্বালে। বইগুলি হারিয়ে যায়। বছর দুয়েক বাদে সেই ছোকরা-প্রকাশক ফের হাজির। শীর্ষেন্দু তাকে বেশ বকাবকি করলেন, সুনীল অফিসে ঢোকামাত্র তাঁকেও বলে রাখলেন, ‘‘আপনিও আর বই দেবেন না কিন্তু।’’ সুনীল: “না, না, অন্যায় করছে। আসুক, আমি বকে দেব।” পরের ঘটনা শীর্ষেন্দুর এখনও মনে আছে। সেই প্রকাশক আসার পরে সুনীল বললেন, ‘‘ভাই, এ রকম করলে চলে? কাজটা তো ঠিক করে করতে হবে।’’ এবং ফের তাকে আর একটি বই ছাপার অনুমতি। শীর্ষেন্দু হতবাক, ‘‘সুনীল, এই আপনার বকার নমুনা?’’ সুনীল লাজুক হাসলেন, “নতুন ছেলে। প্রথমে পারেনি। এ বার বোধহয় ওর ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে যাবে, না?’’
এই উঠতি প্রকাশক এবং লিটল ম্যাগাজিনগুলিকে সুনীল যদি জীবদ্দশায় কোনও অনুমতি দিয়ে যান, আপনারা উঠিয়ে নেবেন? “একেবারেই না। আমি এবং মা দু’ জনেই মনে করি, সেটা বাবার স্মৃতির প্রতি অবিচার হবে। আমরা শুধু ব্যাপারটা গোছানোর চেষ্টা করছি,” জানালেন শৌভিক।
ডিসেম্বর মাসেও তাঁরা অনুরূপ একটি আইনি নোটিস দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই নোটিসে নীললোহিত, সনাতন পাঠক এবং নীল উপাধ্যায়ের নাম ছিল না। আইনজ্ঞের বক্তব্য, ছদ্মনামও নোটিসে দরকার। তাই দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপন।
এ বার বইমেলায় সাহিত্য সমাবেশ থেকে বইয়ের স্টল সর্বত্র থাকবে সুনীলের অনুপস্থিত উপস্থিতি। এমনকী, জয়পুর সাহিত্য উৎসবেও থাকছে ‘রিমেম্বারিং সুনীলদা’ নামের একটি সেশন। সেখানে সুনীলের স্মৃতিচারণ করবেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র নায়িকা শর্মিলা ঠাকুর। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি, তাঁর বইগুলি স্ট্রিমলাইন করা।
উদ্যোগটা নজর কেড়েছে অনেকের। সুনীলের মতোই সমরেশ বসু স্বনামের পাশাপাশি কালকূট এবং ভ্রমর দুই ছদ্মনামে লিখেছেন। কিন্তু তাঁর পুত্র দেবকুমার বসু প্রকাশনা জগতের সঙ্গে যুক্ত বলে অনেক সমস্যা এড়ানো গিয়েছিল। সমরেশ বসু কোন প্রকাশকের ঘরে যাবেন, আর কালকূট কার ঘরে সেটি জীবদ্দশাতেই সমরেশ স্থির করে গিয়েছিলেন। বুদ্ধদেব বসুর কনিষ্ঠা কন্যা দময়ন্তী বসু সিংহ বছর কয়েক আগে প্রকাশনা ব্যবসায় এসেছেন। তাঁর সম্পাদনায় বুদ্ধদেবের অনেক অগ্রন্থিত গদ্য, পুরনো কবিতা পত্রিকা ছেপে বেরিয়েছে। দময়ন্তী জানাচ্ছেন, ‘‘আমিও ওই রকম নোটিস দেব ভাবছি।” বুদ্ধদেবের ‘সাড়া’, ‘মৌলীনাথ’ ইত্যাদি উপন্যাস আউট অফ প্রিন্ট। তাঁর ‘রচনাবলি’ও আর পাওয়া যায় না। ‘মনের মতো মেয়ে’ উপন্যাসটিও দীর্ঘকাল পাওয়া যেত না। অবশেষে দময়ন্তী সেটি বুদ্ধদেব বসুর ‘দশটি উপন্যাস’ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেন। দিল্লিতে অরুণাভ সিংহ সেই বই পড়ে ‘মনের মতো মেয়ে’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। তার পর ইংরেজি থেকে ফরাসি, স্প্যানিশ ও কোরীয় ভাষায় অনূদিত হয় সেই উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতেও আজ লেখকের সব ক’টি বই এবং তা নিয়ে তথ্য হাতের নাগালে থাকা জরুরি।
সুনীল নিজে এ সব ব্যাপারে ছিলেন উদাসীন। আনন্দ পাবলিশার্সের সুবীর মিত্রের মনে আছে, বই কবে বেরোবে জানতেও চাইতেন না। শুধু ‘মনের মানুষ’-এর পর বলেছিলেন, ‘‘এটা বইমেলার আগে কোরো। ইংরেজি অনুবাদ জানুয়ারিতে বের হচ্ছে। তার আগে যেন বাংলা বইটা বের হয়।’’ কোনও গল্প বা উপন্যাস জমেনি বললেও স্মিত হাসিতে বরাবর উড়িয়ে দিয়েছেন, “দু’চারটে বাজ সুনীল চলে গিয়েছেন। তাঁর অবর্তমানে হাতের কাছে সব বই এবং তথ্য না থাকলে বাংলা সাহিত্যের অনেক কিছু এসে যায়। |