হাজারো প্রকল্পে নিত্যদিন প্রচুর অর্থ খরচ করে চলেছে রাজ্য সরকার। কিন্তু অন্যান্য রাজ্যের মতো হিমোফিলিয়া রোগীদের জন্য তারা কেন নিখরচায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে না, শুক্রবার এই প্রশ্ন তুলল কলকাতা হাইকোর্ট।
হিমোফিলিয়া রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে এ দিন একটি জনস্বার্থের মামলার শুনানি ছিল হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চে। আবেদনকারীদের বক্তব্য, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, অন্ধ্র, কর্নাটকের মতো রাজ্যে সরকারি অর্থে হিমোফিলিয়া রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে চিকিৎসার খরচ জোটাতে নিরন্তর সংগ্রাম করে যেতে হয় হিমোফিলিয়া রোগীদের। ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে না-পেরে মৃত্যু হয় বহু রোগীর। পশ্চিমবঙ্গ সরকার হিমোফিলিয়া রোগীদের চিকিৎসার ব্যাপারে কোনও সাহায্যই করে না।
অন্য রাজ্য হিমোফিলিয়া রোগীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন এত উদাসীন, সরকারি আইনজীবীর কাছে জানতে চান প্রধান বিচারপতি। জানতে চান, রাজ্যে হিমোফিলিয়া রোগীর সংখ্যা কত? সরকারি আইনজীবী তপন মুখোপাধ্যায় জানান, চার বছর আগেকার হিসেব অনুযায়ী রাজ্যে হিমোফিলিয়া রোগীর সংখ্যা ১৭ হাজার ২০০। বিচারপতি মিশ্রের প্রশ্ন, নিখরচায় ওই রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বছরে কত খরচ হতে পারে? তপনবাবু জবাব দেন, অন্তত ৩২ কোটি টাকা লাগবে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, এত মানুষ হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত। তাঁদের অনেকেরই চিকিৎসার খরচ বহনের সামর্থ্য নেই। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা কী? রাজ্য সরকারের পক্ষে হিমোফিলিয়া রোগীদের চিকিৎসার আর্থিক দায়ভার বহন করা যে সম্ভব নয়, সরকারি আইনজীবী তা জানিয়ে দেন। সরকারের এই মনোভাবে অসন্তুষ্ট প্রধান বিচারপতির প্রশ্ন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজ্য প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় করছে। ওই ৩২ কোটি টাকা দিতে তাদের সমস্যাটা কোথায়? তিনি বলেন, “স্বাস্থ্য পরিষেবার গুরুত্ব সব থেকে বেশি। তাই রোগীদের স্বার্থের ব্যাপারে সরকার উদাসীন থাকতে পারে না।”
হিমোফিলিয়া রক্তের এক জটিল অসুখ। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, মহিলারা এই রোগের বাহক। কিন্তু আক্রান্তেরা পুরুষ। হিমোফিলিয়া সোসাইটি কলকাতা শাখার সম্পাদক রবিশঙ্কর ওঝা বলেন, “রক্তে ১৩ ধরনের প্রোটিন থাকে। তার মধ্যে বিশেষ তিনটি প্রোটিন অনুপস্থিত থাকলে রক্ত জমাট বাঁধে না। সেটাই হিমোফিলিয়া। সামান্য ধাক্কা লাগলেও শরীরে ভিতরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়।” এর চিকিৎসা কী? রবিশঙ্করবাবু বলেন, “জন্মগত এই রোগ সারে না।” তবে চিকিৎসকেরা জানান, রক্তক্ষরণ ঠেকাতে গেলে এক ধরনের অ্যান্টি ফিমোফিলিক ইঞ্জেকশন দিতে হয়। সেই ইঞ্জেকশনের প্রতিটি ভায়ালের দাম আড়াই হাজার টাকা। রবিশঙ্করবাবু বলেন, “আমাদের কেন্দ্রে আমরা মাত্র ১১০০ রোগীকে পরিষেবা দিতে পারি। বাকিরা পরিষেবার বাইরে। সরকার এঁদের সাহায্য করতে এগিয়ে না-এলে এঁরা কোথায় যাবেন?”
ওই রোগী বা তাঁদের পরিবারের যে সত্যিই কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, নদিয়ার এক হিমোফিলিয়া রোগীর বাবার কথায় ফুটে উঠেছে সেই অসহায়তা। আদালত কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “রাজ্য সরকার ক্লাবগুলিকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিচ্ছে। বিভিন্ন উৎসবে খরচ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। কিন্তু আমাদের বাচ্চাদের বাঁচাতে সরকারের কোনও উদ্যোগই নেই। কোথায় যাব আমরা!”
সরকারি উদ্যোগ নেই কেন, উচ্চ আদালতের প্রশ্ন সেটাই। মুখের ক্যানসারের অন্যতম কারণ গুটখার বিক্রি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে রাজ্য সরকার কেন উদাসীন, হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বৃহস্পতিবার প্রশ্ন তুলেছিলেন। এ দিন হিমোফিলিয়া সংক্রান্ত মামলায় তিনি রিপোর্ট তলব করেছেন স্বাস্থ্য দফতরের কাছে। হিমোফিলিয়ার রোগীদের কাছে চিকিৎসা পৌঁছে দিতে সরকারের পরিকল্পনা কী, বিগত বছরগুলিতেই বা সরকারি তরফে কী কী করা হয়েছে দু’সপ্তাহের মধ্যে তার সবিস্তার তথ্য পেশের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
থ্যালাসেমিয়ার রোগীরা সরকারি প্রকল্পে চিকিৎসার সুযোগ পান। কিন্তু হিমোফিলিয়ার ক্ষেত্রে তেমন কিছুই নেই। কেন? স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, “হিমোফিলিয়া নিয়েও পরিকল্পনা রয়েছে। সেটা ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত হবে। সহায়তা চাওয়া হবে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির কাছেও। হাইকোর্টে রিপোর্ট পেশ করে আমরা সেই কথাটাই জানিয়ে দেব।” |