এক দিকে বিজেপি-র উত্থান। অন্য দিকে সংখ্যালঘু-ভোট। তিন বিধানসভা কেন্দ্রের আসন্ন উপনির্বাচনে যুযুধান সব শিবিরের ভাবনায় উঠে আসছে ধর্মভিত্তিক মেরুকরণের এই অঙ্ক।
মালদহের ইংরেজবাজার, মুর্শিদাবাদের রেজিনগর এবং বীরভূমের নলহাটি, তিনটি কেন্দ্রই গত বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের দখলে এসেছিল। নলহাটি এবং রেজিনগরে সংখ্যালঘু ভোট বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে কংগ্রেস, তৃণমূল এবং বাম তিন পক্ষকেই। আবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংখ্যালঘু-নীতির বিপরীতে হিন্দু ভোট জড়ো করার তাগিদে এই দুই কেন্দ্রেই বিজেপি-র লড়াই ভিন্ন মাত্রা পেতে চলেছে। আর ইংরেজবাজারে বিজেপি বহু দিন ধরেই কিছু ভোট পায়। এ বার তাদের ভোটের হার বৃদ্ধি পেলে কংগ্রেস এবং তৃণমূল, দু’দলই বিপদে পড়বে বলে আশা করছে সিপিএম।
রাষ্ট্রপতি-পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় সাংসদ হয়ে যাওয়ায় নলহাটিতে বিধানসভা উপনির্বাচন করতে হচ্ছে ২৩ ফেব্রুয়ারি। ওই দিনই ভোট ইংরেজবাজার ও রেজিনগরেও। যেখানকার দুই কংগ্রেস বিধায়ক কৃষেন্দু চৌধুরী ও হুমায়ুন কবীর দল তৃণমূলে গিয়ে এখন মন্ত্রী। তিন কেন্দ্রই যেমন এক দিকে কংগ্রেসের দুর্গ রক্ষার লড়াই, তেমন কৃষেন্দু ও হুমায়ুনের দৌলতে ওই দু’টি আসন তৃণমূলের কাছে সম্মান রক্ষার যুদ্ধ। আবার উল্টো দিকে, বামেদের কাছে হারানোর কিছুই নেই। বহুমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার জেরে কোনও আসন বার করতে পারলে তাদের বাড়তি লাভ। পঞ্চায়েত ভোটের আগে যা তাদের অক্সিজেনের কাজ করবে।
পরিস্থিতি বুঝে বামেরা কোনও কেন্দ্রেই প্রার্থী বদলাতে বিশেষ উৎসাহী নয়। ইংরেজবাজারে ফের সিপিএম প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা সমরেন্দ্রনাথ রায়ের। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, “সমরবাবু পরিবর্তনের বাজারেও খুব বেশি ভোটে হারেননি। ওখানে বিজেপি-র ভোটের হার ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তা আরও বাড়তে পারে। এবং সেটা হলে আমাদের লাভ।” একই রকম ভাবে নলহাটিতে প্রথমে সংখ্যালঘু প্রার্থীর কথা ভেবেও পরে জেলার পরিচিত নেতা দীপক চট্টোপাধ্যায়কেই দাঁড় করানোর দিকে ঝুঁকে রয়েছে বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক। দীপকবাবু ওই কেন্দ্রের প্রাক্তন বিধায়কও বটে। ফব-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “সংখ্যালঘু প্রার্থী হলে বাকি ভোটটা টেনে নিতে বিজেপি-র সুবিধা হয়ে যেতে পারে। মুখ্যমন্ত্রীর সংখ্যালঘু তোষণের জন্য বিজেপি এখন ভালই ছাপ ফেলছে। আবার অবাস্তব প্রতিশ্রুতি ধরে ফেলে সংখ্যালঘুরাও ক্ষিপ্ত হচ্ছেন। এই সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে হবে।”
রেজিনগর যেমন হুমায়ুনের, তেমনই কংগ্রেসের জেলা সভাপতি অধীর চৌধুরীর কাছে সম্মানের লড়াই। অধীরের কংগ্রেস কতটা মরিয়া হয়ে সেখানে ঝাঁপাবে, সেই দিকে নজর রাখছে আরএসপি। মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের সহ-সভাপতি সিরাজুল ইসলামকেই ফের প্রার্থী করার কথা ভেবেছে তারা। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের মতে, “ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতাই আমাদের পক্ষে ইতিবাচক হতে পারে।”
শাসক জোট ছেড়ে বিরোধী ভূমিকায় যাওয়ার পরে কংগ্রেসের কাছে স্বভাবতই এই ত্রিফলা উপনির্বাচনের গুরুত্ব অনেক। কিন্তু দুর্গ আগলাতে নেমে প্রার্থী বাছাইয়ে খুব স্বস্তিতে নেই তারা। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলছেন, “তিন জেলা সভাপতিকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা দিতে বলা হয়েছে ২১ জানুয়ারির মধ্যে। তার পরে ২২ তারিখ এআইসিসি-র নির্বাচন কমিটির কাছে আমাদের তালিকা পাঠিয়ে দেওয়া হবে।” তবে কংগ্রেস সূত্রের খবর, তিন কেন্দ্রের মধ্যে নলহাটির জটিলতাই সব চেয়ে বেশি। সাংসদ অভিজিৎবাবুর স্ত্রী তথা রাষ্ট্রপতির পুত্রবধূ চিত্রলেখা মুখোপাধ্যায়কে প্রার্থী করতে উৎসাহী কংগ্রেসের একাংশ। আবার জেলা কংগ্রেসের একাংশ চাইছে, বারবার বাইরে থেকে কাউকে প্রার্থী না-করে স্থানীয় কাউকে টিকিট দেওয়া হোক। ইংরেজবাজারে কৃষেন্দু আবার তৃণমূলের মন্ত্রী তথা প্রার্থী কিন্তু কংগ্রেস পরিচালিত পুরসভার প্রধান, এই সমীকরণও প্রদীপবাবুদের কাছে মাথাব্যথার কারণ।
জঙ্গিপুরের দৃষ্টান্ত মাথায় রেখে এই আবহে ভাল ফল করার আশায় তিন কেন্দ্রের জন্যই একাধিক প্রার্থীর নাম দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে রাজ্য বিজেপি। আর তৃণমূল? বিরোধীরা সরকারের বিরুদ্ধে যতই হইচই করুক, পঞ্চায়েত ভোটের আগে আম জনতার মন এখনও তাদের দিকেই আছে প্রমাণ করার জন্য এই উপনির্বাচনই অস্ত্র হবে তৃণমূলের। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের কথায়, “আমাদের আর কী? দু’টো কেন্দ্রের প্রার্থী তো হয়েই আছে! শুধু এক জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করতে হবে! আগে বড় পার্টি (কংগ্রেস) নলহাটিতে প্রার্থী দিক!” |