আর কোনও রাখঢাক নয়। তৃণমূলকে রুখতে বিজেপি বাদে যে-কোনও রাজনৈতিক শক্তিকে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে সমর্থন করবে সিপিএম। পার্টির রাজ্য নেতৃত্ব প্রাথমিক ভাবে এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সে ক্ষেত্রে মূলত কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের অঘোষিত এক প্রাক-নির্বাচনী সমঝোতা এ বার পঞ্চায়েত ভোটে হয়েই রইল।
একই সঙ্গে এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে সিপিএম নেতৃত্ব আবারও স্বীকার করে নিলেন, পঞ্চায়েতের বহু আসনে তাঁরা এ বার লড়াই করা তো দূরস্থান, প্রার্থী দাঁড় করানোর মতো অবস্থাতেই নেই। দলীয় সূত্রের খবর, বিভিন্ন জেলা থেকে রাজ্য নেতৃত্বের কাছে এখনও পর্যন্ত আসা রিপোর্ট অনুযায়ী, অন্তত ২০ শতাংশ আসনে সিপিএম তথা বামফ্রন্ট প্রার্থী দিতে পারবে না।
দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু গত ডিসেম্বর মাসে রাজ্য কমিটির বর্ধিত বৈঠক থেকে জেলার নেতাদের যতই পঞ্চায়েতের সব আসনে প্রার্থী দাঁড় করানোর নির্দেশ দিন, বাস্তব পরিস্থিতি যে আদৌ তার পক্ষে সহায়ক নয়, বিভিন্ন জেলার রিপোর্ট থেকেই তা আরও এক বার পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। দলীয় নেতৃত্বের একাংশ একটা সময়ে ভেবেছিলেন, দলীয় প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হতে কেউ রাজি না-হলে কাউকে নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানো হবে এবং দল তথা বামফ্রন্ট তাঁকে সমর্থন দেবে। কিন্তু জেলাগুলির পাঠানো রিপোর্ট বলছে, অনেক জায়গায় দলীয় কর্মীদের নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড় হওয়ার মতো অবস্থাও নেই। পার্টি সূত্রের খবর, সে জন্যই বিজেপি বাদে অন্য যে-কোনও রাজনৈতিক শক্তিকে সমর্থন জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্র বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে পঞ্চায়েত নির্বাচনে সব আসনে আমরা প্রার্থী দিতে পারব না। এটাই বাস্তব। কিন্তু তৃণমূলের মতো স্বৈরাচারী শক্তিকে পরাস্ত করাটাই এখন প্রধান লক্ষ্য। যে-সব জায়গায় আমরা প্রার্থী দিতে পারব না, সেখানে অন্য যে-কোনও রাজনৈতিক শক্তিকে আমরা নৈতিক সমর্থন দেব। তা বলে বিজেপি-র মতো সাম্প্রদায়িক দলকে আমরা কখনও সমর্থন করব না।”
অমিয়বাবু বাঁকুড়ায় দলের জেলা সম্পাদকও। পার্টির ওই প্রবীণ নেতার বক্তব্য, নিজের জেলা ও পুরুলিয়ায় পার্টির অনুকূলে পরিস্থিতি কিছুটা ভাল হলেও পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রাম, লালগড়, গোয়ালতোড়, জামবনি, শালবনির মতো বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রার্থী দাঁড় করানো যাবে না। দলীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত, জঙ্গলমহলে মাওবাদী গণসংগঠনের সদস্য-সমর্থকেরা পঞ্চায়েত ভোটে নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ালে তাঁদের পরোক্ষে সমর্থন করা হবে। দলীয় প্রার্থী না-দিতে পারলে সেখানে ঝাড়খণ্ড পার্টির প্রার্থীদেরও বামফ্রন্ট সমর্থন করবে বলে সিপিএম সূত্রের খবর।
একই সঙ্গে পার্টির রাজ্য নেতৃত্ব স্বীকার করছেন, শুধু ‘তৃণমূলের সন্ত্রাস’-ই এই অবস্থার জন্য দায়ী নয়, দলীয় ত্রুটিবিচ্যুতিও রয়েছে বিস্তর। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ও তৃণমূলের বিস্তর ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ তৈরি হলেও এখনও আমরা বেশ কিছু জায়গায় ২০১১-র বিধানসভা ভোটের বিপর্যয়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে পারিনি। আমাদের আন্দোলন ওই সব এলাকায় আদৌ জমাট বাঁধতে পারেনি। ওই সব জায়গায় আমাদের দলীয় নেতৃত্বের একাংশকে সাধারণ মানুষ অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। বিশেষ করে পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর ও হুগলির মতো জেলায়।” তবে অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে, পঞ্চায়েত ভোটে রাজনৈতিক দলগুলির ওপরতলার নেতৃত্বের নির্দেশ অনেকসময়েই নিচু তলা অনুসরণ করে না।
সেখানে ব্যক্তিগত বা আঞ্চলিক নানা সমীকরণ প্রভাব ফেলে। সেই বিষয়টিও মাথায় রাখছেন সিপিএম নেতৃত্ব।
এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তিনটি স্তর মিলে আসনসংখ্যা হয়েছে ৫৮৭৭৪। ২০০৮ সালে পঞ্চায়েতের তিনটি স্তর মিলে আসনসংখ্যা ছিল ৫১০৫২। সে বার জেলা পরিষদের ৭৪৮টি আসনের মধ্যে বামফ্রন্ট পায় ৫১৭টি, পঞ্চায়েত সমিতির ৮৮০০ আসনের মধ্যে ৪৮৯৪টি এবং গ্রাম পঞ্চায়েতের ৪১৫০৪টি আসনের মধ্যে ২১৭৮০টি আসন। কিন্তু ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে বামফ্রন্ট এর অর্ধেক সাফল্যও ধরে রাখতে পারেনি। আর এ বার পঞ্চায়েত ভোটে ২০১১-র বিধানসভা ভোটের চেয়ে ভাল ফল করাই চ্যালেঞ্জ সিপিএমের। অমিয়বাবু বলেন, “২০০৮-এর ফলের সঙ্গে তুলনা করে লাভ নেই। তবে ২০১১-র চেয়ে ভাল ফল হবে বামফ্রন্টের।”
আর সেই ভাল ফলের মানদণ্ড হল-নিজেদের দলীয় প্রতীকে ক’টা আসন পাওয়া গেল, তা শুধু নয়, বরং ২০১১-র তুলনায় তৃণমূলের কতগুলো আসন কমল বলে জানাচ্ছেন পার্টি নেতৃত্বের একাংশ। কারণ, সেই মানদণ্ডেই দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে। |