রাজধর্মের মোড়কে গৃহশাসন!
একটু বিলম্বে হলেও ভাঙড়ের ঘটনায় আরাবুল ইসলামকে গ্রেফতার করিয়ে দলের মধ্যে কাউকে কাউকে কি বার্তা দিতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? ভাঙড়ের প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক পুলিশি হেফাজতে চলে যাওয়ার পরে এমন জল্পনাই ঘুরপাক খাচ্ছে শাসক দলের অন্দরে। তৃণমূল নেতাদের অনেকেই প্রশ্ন, এক আরাবুলকে কেন্দ্র করে দুই পর্বে দলের দুই গুরুভার নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে কি একটু সবক শেখালেন দলনেত্রী?
এমন জল্পনার কারণ, বিধায়ক থাকাকালীন আরাবুল ছিলেন পার্থবাবুরই ছত্রচ্ছায়ায়। পার্থবাবু
তখন বিরোধী দলনেতা। ভাঙড়েই বিতর্কিত কিছু লেনদেনে জড়িয়ে-পড়া আরাবুলকে সতর্ক করে পথে ফিরিয়েছিলেন পার্থবাবু। তার পর তৃণমূলের অন্দরে অনেক পট পরিবর্তন হয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব শোভন চট্টোপাধ্যায়, চৌধুরী মোহন জাটুয়ার মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। গত বিধানসভা ভোটে হেরেও গিয়েছেন আরাবুল। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে পার্থবাবুর দুর্বলতা যায়নি বলেই তৃণমূল সূত্রে খবর। ভাঙড় কলেজের পরিচালন সমিতিতে আরাবুলের স্থান পাওয়ার পিছনে পার্থবাবুর ভূমিকা ছিল বলেই জানাচ্ছেন তাঁরা।
তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার সরস মন্তব্য, “সরকারে কে ‘নাম্বার টু’, এই নিয়ে সুব্রতদা আর পার্থদার মধ্যে একটা দড়ি টানাটানি আছে। ভাঙড়ের ঘটনায় রাজ্যপালকে আক্রমণ করে বাড়তি মন্তব্য করতে গিয়ে সুব্রতদা একটু কোণঠাসা হওয়ায় পার্থদার ঘনিষ্ঠ লোকেরা ভাবছিলেন, কিছু সুবিধা হল! কিন্তু আরাবুলের গ্রেফতার স্কোর ১-১ করে দিল!”
বস্তুত, তৃণমূল নেত্রীর পরের সারিতেই শাসক দলের নেতা তিন জন। পার্থবাবু, সুব্রতবাবু এবং সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। ঘটনাচক্রে, আরাবুলের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা নেওয়ার পিছনে দলীয় স্তরে ভূমিকা ছিল মুকুলবাবুর। তিনি আরাবুলের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে সংযত হতে বলেছিলেন। দলনেত্রীর কাছেও প্রয়োজনীয় বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। এই ঘটনাও পার্থবাবুর পক্ষে খুব একটা সুখকর নয়
বলে তৃণমূলের একাংশের অভিমত।
আরাবুলের গ্রেফতারির পরে পার্থবাবু নিজে অবশ্য সংযত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। দলের কেউ যাতে এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি না করেন, তার জন্যও সক্রিয় ছিলেন
তিনি। তৃণমূল সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, দল ও সরকারের তরফে এখন আনুষ্ঠানিক বক্তব্য জানানোর দায়িত্ব পার্থবাবু ও
ফিরহাদ হাকিমের উপরে। ফিরহাদ অসুস্থ বলেই পার্থবাবুকে সক্রিয়
হতে হয়েছে।
পার্থবাবু নিজে অবশ্য বলছেন, “কোনও এক জন নয়, আরাবুলের ঘটনা দলের সকলের কাছেই বার্তা। যাঁরা দলের ভাবমূর্তির ক্ষতি করবেন, তাঁদের সকলের ব্যাপারেই দল যথাসময়ে পদক্ষেপ করবে।” পাশাপাশিই তাঁর প্রশ্ন, “যাঁরা শুধু তৃণমূলের কিছু ঘটনা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন, শাসনের মজিদ মাস্টার বা পশ্চিম মেদিনীপুরের তপন-সুকুরের বেলায় তাঁরা কী বলবেন? তৃণমূল তো ব্যবস্থা নিয়েছে। সিপিএম জমানায় ওই সব নেতাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল?” প্রসঙ্গত, শুক্রবার সরকারি অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, সিপিএমের লোকজনের বাধায় অনেক জায়গায় উন্নয়নের কাজ বাধা পাচ্ছে। কিন্তু তা-ই বলে কারও গায়ে হাত তোলা যায় না! মিষ্টি মুখেই তাদের বোঝাতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য আরাবুল-কাণ্ডের দিকেই ইঙ্গিত বলে মনে করা হচ্ছে।
পার্থবাবুর মতোই তৃণমূল আপাতত সিপিএমের দিকে তির ঘোরাতে
ব্যস্ত। আরাবুলের গ্রেফতারিকে পরিকল্পনামাফিক ঘটনা এবং ‘গট-আপ’ বলে মন্তব্য করেছিলেন রেজ্জাক। তাঁর ওই মন্তব্য নিয়ে প্রশ্নের জবাবে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র এ দিন বলেছেন, “মেডিক্যাল বোর্ড করে রেজ্জাক মোল্লার জন্য মনোরোগ চিকিৎসক রাখতে বলুন!” এই আবহে হাসপাতালে রেজ্জাকের জন্য দলের নেতাদের লাইন কিন্তু অব্যাহত! তাঁকে দেখতে এ দিন গিয়েছিলেন পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি এবং হান্নান মোল্লা, তাপস সিংহেরা। পলিটব্যুরোর আরও দুই সদস্য বৃন্দা কারাট এবং
এস আর পিল্লাইয়ের যাওয়ার কথা আজ, শনিবার।
তৃণমূলের এক রসিক নেতার কথায়, “লাল কার্ড দেখলেন আরাবুল। পার্থবাবু হলুদ কার্ড! আর পয়েন্ট ঘরে তুললেন রেজ্জাক মোল্লা!” |