নাটক সমালোচনা...
শান্তাপ্রসাদের প্রত্যাবর্তন
৯৭৪ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলার রঙ্গমঞ্চে মঞ্চস্থ হয়েছিল ব্রেট্রোল্ট ব্রেখট অবলম্বনে নান্দীকার প্রযোজিত অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাটক ‘ভালোমানুষ’।
২০১২--এ বার পূর্ব-পশ্চিম। এ বারও ব্রেখট। এ বারও অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভালোমানুষ’। আমার খুব প্রিয় পরিচালক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, যাঁর ‘সর্পমস্তা’ মুগ্ধ করেছে আমায়, আমাদের। বারেবারেই ‘ভালোমানুষ’ বিভিন্ন ফর্মে ফিরে এসেছে থিয়েটারে। আমার অবশ্য কোনওটাই দেখার সৌভাগ্য হয়নি। সৌভাগ্য হয়নি থিয়েটারের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তী অভিনীত ‘শান্তাপ্রসাদ’ দেখারও। চেতনার ভালোমানুষের পালা বা অপর্ণা সেন, দীপঙ্কর দে অভিনীত ‘ভালোখারাপ মেয়ে’ কোনওটাই দেখিনি। তবে খুব সম্ভবত ১৯৯৬-এ নান্দীকারের ‘শঙ্খপুরের সুকৈন্যা’ দেখেছিলাম। স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত অভিনয় করেছিলেন।
বেশ কয়েকটা বছর ‘বহুরূপী’তে থিয়েটার করার সুবাদে অনেক বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসেছি। তাঁদের মুখে থিয়েটারের বিবর্তন, পরিবর্তন শুনে বড় হয়েছি। মনে আছে এই প্রশ্নটা করেছিলাম আচ্ছা, বাংলার রঙ্গমঞ্চে কেন বারেবারে ‘ভালোমানুষ’ বিভিন্ন ফর্মে ফিরে আসে? কেন থিয়েটারপ্রেমী মানুষ বিভিন্ন ভাবে শান্তাপ্রসাদকে মঞ্চে ফিরিয়ে আনতে চান? বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের জঞ্জালে ধনী-দরিদ্রের সমতা হারানো পৃথিবীতে, মানুষই সৃষ্টি করছে মানুষের সমস্যা। বর্তমান অবক্ষয়ের সমাজে ‘ভালোমানুষ’দের বড় অভাব। তাই বারেবারে ‘ব্রেখট’, বারেবারে ‘ভালোমানুষ’-এর অনুসন্ধান?
পূর্ব-পশ্চিমের ‘ভালোমানুষ’ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া নামেই। সংলাপও অপরিবর্তিত। অন্তত চারটে গান একই। কিছু গান পরিচালক রচিত। ‘হাত ছুঁয়ে দেখ’ গানটি ওপার বাংলার শিল্পী কৃষ্ণকলির। সুন্দর। মূল নাটকটি ছিল তিন ঘণ্টার। দেবেশও তাই ভালোমানুষকে ২ ঘণ্টা দশ মিনিটে বেঁধেছেন। মূল নাটকটিতে বেশ কয়েকটি বিখ্যাত গান রয়েছে। বিশেষ করে ‘আমি যখন ছেলে থাকি’ বা ‘আট ঘোড়ার নাচ’ বা ‘কাঁদছে শান্তা’। ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় সুরটা অপরিবর্তিত রাখলে বেশ হত। নাম ও সংলাপ পরিচালক অপরিবর্তিত রেখেছেন। আবার এটাও ঠিক পুরোনো ঐতিহ্য মাথায় রেখে নতুন ভাবে কিছু উপস্থাপনা করাই তো আধুনিকতা।
রতন থিয়ামের মঞ্চস্থ নাটক ‘দ্য সিগাল’ দেখেছিলাম। কোনও প্রপস নেই। উত্তরীয় কখনও হয়ে যাচ্ছে রশি, কখনও তলোয়ার, কখনও লাঠি। এই নাটকেও দেবেশ কুশীলবদের কোনও প্রপস দেননি। কার্যত টাকা দেওয়া, বাচ্চা সামলানো (শান্তার) কিংবা মাখনবাবুর হাতে ধরা কাল্পনিক ছড়ি, দোকানিদের কেনাকাটা ইত্যাদি অনেক কিছু। প্রশ্ন, যদি কুশীলবদের অভিনয়ের ক্ষেত্রে এই অভিনবত্ব আনতেন পরিচালক তা হলে সে ক্ষেত্রে ‘মাইম’টা আরও সার্থক হতে পারত।
মলয় সাহা ছোট ছোট অভিব্যক্তিতে এবং আঙ্গিক অভিনয়ে বুঝিয়ে দেন মঞ্চ তার অনেক দিনের চেনা জায়গা। তার ক্ষেত্রেও প্রপস কেন? ভগবান ব্রহ্মা-বিষ্ণু পৃথিবীতে এসে পৃথিবীর কালিমার দ্বারা দৃষ্টিহীন তাঁদের হাতেও যষ্টি কেন? অথচ কী নিপুণ লাগে মঞ্চসজ্জায় মঞ্চের উপর থেকে ফেলে দেওয়া রঙিন কাপড়ের ব্যবহার। কখনও তা হয়ে যাচ্ছে দোকান, কখনও রাস্তা, কখনও কারখানা, কখনও বাসস্থান আবার কখনও বিয়ের বাসর। বিয়ের আগে শান্তা-গোবিন্দর প্রেম, গান আর মায়াবী আলো চমৎকার। দলের প্রত্যেককে দেখে ভাল লাগে। তাঁদের পরিশ্রম ও অধ্যবসায়কে ভালবাসতে হয়, তবে অভিজ্ঞতা মানুষকে চিনতে শেখায়, জানতে শেখায়। তাই দর্শকাসনে বসে দলের অভিজ্ঞ শিল্পীদের পাশাপাশি যখন নব্য শিল্পীদের অভিনয়ের সময় মুখে আলোর অভাব হচ্ছিল তখন বোঝা যাচ্ছিল আলো নেওয়ার টেকনিকেও পারদর্শী হতে হবে। বারেবারে শিখেছি মঞ্চে ভুল হলে বুঝতে দিতে নেই। মঞ্চে সুযোগ একবারই। সংলাপ বলা, নিজের আলোটা ঠিক নিয়ে সহ-অভিনেতাদের সঠিক ভাবে আলো ছেড়ে দেওয়া।
গোবিন্দরূপী তথাগত চৌধুরীকে খুব ভাল লাগে। অবাক করার মতো তার আঙ্গিক অভিনয়। দর্শকাসনে বসে মনে হচ্ছিল ইস কী দুষ্টু ছেলেটা, ভাল মেয়েটাকে ঠকাচ্ছে এ ভাবে? এই দুষ্টু ছেলেটারই ঠকানো, রাগ, মিথ্যা কথা বলার বিশ্বাসযোগ্য ভঙ্গিমা কখন যে শান্তার ভালবাসার সময়ের বিবর্তনে বদলে যায়। এই গোবিন্দই যখন বলে, ‘স্যর আপনি আমায় পাঁচশো টাকা বেশি দিয়েছেন।’ বা যখন শান্তার সন্তান যে তারই ঔরসজাত বুঝতে পারে তখনও তার অভিনয়ের এই বৈপরীত্য চমৎকার লাগে। সৌমিত্র মিত্র! এই নাটকে আপনি মাখনবাবু। আদ্যোপান্ত খারাপ লাগা একটা মানুষ, যে মাখনবাবুরা মেয়েদের ভোগ্যপণ্য ছাড়া কিছু মনেই করে না। আস্তে আস্তে ভালমানুষের সরল মানুষিতে সেই মাখনবাবুরাও পরিবর্তিত হয়। সত্যি আপনি এখনও কী প্রাণবন্ত অভিনেতা! প্রত্যেক মুহূর্তে বোঝালেন মঞ্চ আপনার ভালবাসার জায়গা। কাজের উৎস।
চমকে দেয় শান্তারূপী নবাগতা অভীপ্সা কাজী। সুন্দর চেহারা। সুন্দর কণ্ঠ। অভিনয়ে চোখে পড়ার মতো লাবণ্য। বার বার ঠকে গিয়েও শান্তা যেন নতুন উদ্যমে চেষ্টা করছে সমাজকে পরিবর্তন করার। শান্তারা বাসনার সংজ্ঞা জানে না, শুধু আজকের মতো কালও বেঁচে থাকতে চায়। দর্শকাসনে বসে মনে মনে বলছি ‘মেয়েটাকে সবাই এই ভাবে ঠকাচ্ছে ও বুঝতে পারছে না কেন?” ঠিক এইখানেই তো অভিনয়ের সার্থকতা।
শান্তাপ্রসাদ আরও ‘দমদার’ হলে ভাল হত। খুব সুরেলা গলা আপনার। শান্তাপ্রসাদের কর্কশতায় আর একটু নজর দেবেন? হাঁটাচলায় আরও একটু পুরুষালি ইমেজ? দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের মতো পরিচালক, সৌমিত্র মিত্রের মতো অভিজ্ঞ শিল্পী! আমার বিশ্বাস তা সম্ভব। আবহে অভিজিৎ আচার্য ভাল লাগে।
পরিশেষে বলি, যে সমাজে ব্যক্তি সচেতনায় ধনী হওয়ার বাসনা সে সমাজ, মানুষ স্বাধীন ভাবে বাঁচার অর্থকে করে তুলেছে শুধু নিজে বাঁচা। স্বভূমির অস্তিত্বকে নিশ্চিত করতে পরমাণু শক্তিতে পরাক্রমী হয়ে ওঠার লড়াই দেশে দেশে, সেই সমাজে ভালমানুষের প্রয়োজন বড় বেশি। যে সমাজে মেয়েরা মেয়ে হওয়ার আগেই পুরুষ চিনছে সেই সমাজে ভালমানুষের প্রয়োজন বারেবারেই। ভগবানের মেয়েরা ভগবানকে ছাড়াই একা বাঁচবে। শান্তাদের আরও ভাল হয়ে থাকার জন্য কাঁদতে হবে না। সামাজিক অবক্ষয়ের এই পটভূমিতেই ভালমানুষের প্রাসঙ্গিকতা ’৭৪-এর মতো ২০১২-তেও।
হয়তো আগামী বছরেও।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.