বেড়ানো...
শ্রীমতী ভজহরি মান্না
মিতা, রিয়া, পৃথা মিলে আজ বছর কয়েক হল কমপ্লেক্সের পিকনিকটা বন্দোবস্ত করছে। আশপাশে বেশ কয়েকটা কমপ্লেক্সে মেয়েরাই এই কাজটা করে দেখে, ওরা ভরসা করে এগিয়ে এসেছিল। একবার বারাসত, তো পরের বার নরেন্দ্রপুর, তার পরের বার বেহালা। প্রতিবারই লোকে ওদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সাত থেকে সত্তর সব বয়েসের সব্বাই সারা বছর বসে থাকে এই একটা দিনের অপেক্ষায়। কিন্তু এ বারে যে কী হল! শুরুতেই হোঁচট! যা দেখছে, সব জায়গাই বুকড।
জরুরি মিটিং ডেকেছেন সেক্রেটারি পলাশদা। বিজন, রানা, মৃণালকে বলেছেন, ‘শিগগির খবর লাগাও। নইলে এ বারের পিকনিক স্বপ্নই থেকে যাবে।’ শমিতা, রিয়াদের মন খারাপ। শুধু পিকনিকে এলাহি আয়োজন করে ওরা তিনজন এ ক’বছরে ‘শ্রীমতী ভজহরি মান্না’ শিরোপা পেয়েছে, এবার তো সে সম্মান শিকেয় ওঠার জোগাড়! রথীনদা, প্রসূনদার জন্য খারাপ লাগছে সবচেয়ে বেশি। দেখে মনে হচ্ছে, যেন মেয়ের বিয়ে ভেঙে গিয়েছে! ওদের যে সাত কুলে কেউ নেই। পুজো আর পিকনিক, বছরের আনন্দ বলতে তো এ দুটোই!
অন্য বার নভেম্বরেই বুকিং করে ফেলে ওরা। এ বারে করছি-করব করে একটু দেরি। তাতেই এই! কমিউনিটি ক্লাবে মুখ দেখাতেও লজ্জা করছে! অথচ স্পট বাছতে ফোনাফুনি, দৌড়ঝাঁপ যে কম করেছে, তা’ও নয়।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল। সৌজন্য: নেচার পার্ক, তারাতলা
বেহালার ঠাকুরপুকুরের কাছে বিবিরহাট যেমন। তিনশো দশ কাঠার ওপর ঘেরা একটা বাগানবাড়ি। খোঁজ পাওয়া মাত্র ফোন। তাতে শুনল, মাস পড়ার আগে থাকতেই জানুয়ারির শনি-রবি আর ছুটির দিনগুলোয় বুকিং ফুল। এর পর আমতা, জোকা, হোসেনপুর ... কোত্থাও নেই। পুরোনো জায়গাগুলো? সেগুলোরও এক দশা।
কালিকাপুরের কাছে এক রিসর্টের দায়িত্বে আছেন জ্যোতির্ময় চৌধুরী। শমিতার বর রজতের চেনা। তিনি আবার বললেন, “শুধু কর্পোরেট ছাড়া কাউকেই আমরা দিই না।” যা বাব্বা, এ আবার কী! এখন মিটিং পর্যন্ত বসে থাকা ছাড়া আর কোনও গতি নেই। এ বারে শীত চড়া হওয়ার আগে থেকেই বেশির ভাগ রিসর্টেরই রিং টোন থামছে না। যত আঁটোসাঁটো, যত সাফসুতরো, যত আমোদ-আহ্লাদ, চাহিদা যেন তত বেশি। খরচপাতি আকাশছোঁয়া হলেও ঝাঁপিয়ে পড়ছে কর্পোরেটরা। ছুটির দিন মানেই রিসর্টের গেটে ভলভো আর চার চাকার ঢল।
পিকনিক-মস্তিতে অভিজিতের টিপস
• বাসেই ব্রেকফাস্ট, সঙ্গে অন্ত্যাক্ষরী চলুক। স্পটে ক্রিকেট ম্যাচের জন্য ছেলে আর মেয়ে মিলিয়ে দুটো টিম করে ফেলুন
• ম্যাচে ফার্স্ট ইনিংস হলেই ব্রেক। তখন একটু স্ন্যাকস। ড্রিংক
• সেকেন্ড ইনিংস হলেই জমিয়ে লাঞ্চ
• এর পর আড্ডা, পিএনপিসি। বিকেলে চা, হালকা স্ন্যাকস
• তার পর ডিজে পার্টি ডান্স। ড্রিংক
• রাতে ডিনারটা হালকা করে ফিরলেই ভাল
সৌজন্য: অভিজিতের ফেসবুক
তা হলে পিকনিকও কি এখন কর্পোরেটের কব্জায়? তাই কি এত রমরমা! ঠাকুরপুকুরের বাগানবাড়ির মালিক রবীন্দ্র সাহা বলছিলেন,“আমার রিসর্টের বয়েস প্রায় ছ’বছর। এর মধ্যে দুই কি তিন বার ছাড়া সবটাই ছিল কর্পোরেট বুকিং।” কিন্তু ব্যারাকপুরের এক পিকনিক গার্ডেনের প্রবীণ কর্মী বলছিলেন, “দেখুন দামি রিসর্টের জন্য কর্পোরেটের গল্পটা সত্যি হতে পারে। কিন্তু তার বাইরে নয়। এখানকারই শহিদ মঙ্গল পাণ্ডে উদ্যান বা গাঁধী ঘাটে গিয়ে দেখুন। বিশাল ঘেরা বাগানে দলে দলে পিকনিক হচ্ছে। কোথায় কর্পোরেট সেখানে? আসলে আজকাল লোকে একটু প্রাইভেসি চায়। নিরাপত্তা চায়। তার জন্য ঘেরা ভালো জায়গা পেতে উনিশ-বিশ বেশি খরচ করতে কেউ পিছ-পা নয়।”
“পঞ্চাশ-ষাট দশকে তো ছাদে কি লাগোয়া বাগানেই চড়ুইভাতি বসিয়ে দিতেন আমার বাবা-কাকারা। বড়জোর দেশের বাড়ি। তার মধ্যেই খেলা, গান, আড্ডা। লুকিয়েচুরিয়ে প্রেম-পিরিতি। মিন্তির মাসতুতো বোনের সঙ্গে বুলুর পিসতুতো ভাই। ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়/তুমি যে বহ্নিশিখা’!” বলছিলেন উত্তর কলকাতার সৌগত মিত্র, “খাওয়া বলতে সকালে মুড়ি তেলেভাজা। দুপুরে ভাত, খাসির মাংস। শেষে খয়ের দেওয়া মিষ্টি পাতার পান খেয়ে ঠোঁট লাল। সন্ধেবেলা ঝি ঁঝি ঁডাকের বহু আগেই যবনিকা পতন।”
ঠিক তাই। সত্তর-আশির দশকে ছবিটা একটু বদলাল। তখন এল শহর ছাড়িয়ে লরি করে, মাইক বাজিয়ে যাওয়ার ধুম। হাতা, খুন্তি, কড়া, গামলা, বাজার সব সঙ্গে নিয়ে। একটা মাঠ, পাশে নদীর চর কিংবা পুকুর থাকলেই হল। অন্তত একটা টিউবয়েল।
মাটি খুঁড়ে কাঠের জ্বালানিতে উনুন। তাতেই রান্না। কখনও ঠাকুর, কখনও দলেরই এক দুজন মিলে হাত লাগাত। পাশের মাঠে ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন। কাঁচা পাঁউরুটি, শক্ত ডিম, সিঙ্গাপুরি কলা দিয়ে দিন শুরু। মাঝে লুচি, তরকারি। বিকেল হয়ে সন্ধে নামার একটু আগে মাটিতে কাপড় বিছিয়ে কলাপাতায় করে ভাত আর মাটির খুরিতে ব্রহ্মতালু জ্বালিয়ে দেওয়া আধসেদ্ধ ঝাল মাংস। তার পর কোনও এক গোবিন্দদা বা নিতাইকে নিয়ে টানাটানি। একটু বেশি সেবন করে ওরা তখনও লাট।
পিকনিকের আলুথালু চেহারার এ রকমই একটা ছবি হানা দেয় অনেককেই!
এখন গোড়া থেকেই ছবিটা এক্কেবারে আলাদা। গাছগাছালিতে ছাওয়া রিসর্ট চাই। অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, ওয়াটার পার্ক না হলে নাইন-টেনের বাচ্চাদের পাওয়া যায় না। ওয়ান ডে বা টি টোয়েন্টি থাকলে টিভিটাও চাই। আয়েশ করার দুয়েকটা ঘর চাই। বছর দশ কী পনেরো ধরে বেড়ে উঠেছে এমন অসংখ্য ডেরা। তার সব ক’টাই যে দামে চড়া তা’ও নয়। “আমরা স্কুলের পুরোনো বন্ধুরা মিলে ফ্যামিলি-ট্যামিলি নিয়ে লঞ্চে পিকনিক করলাম, এই তো বছর তিন আগে।” বললেন মাঝবয়েসি ব্যবসায়ী জয়দীপ ঘোষ।
এক্সক্লুসিভ
অনুপমের ছড়া
গায়ক-কবি অনুপম রায়। পিকনিক নিয়ে
ছড়া লিখেছেন পত্রিকার পাঠকদের জন্য
ভেনু তো বদলেছেই, সঙ্গে বদলেছে মেনুও। বাড়ি থেকে বয়ে আনা বাসনপত্তর, কাঁচা বাজারের হ্যাঁপাও উঠে গিয়েছে। অনেক স্পটেই মজুত রিসর্টের নিজস্ব কেটারার। থাকার সঙ্গে খাওয়ার প্যাকেজ পাওয়া যাচ্ছে। তা না থাকলে সঙ্গে কেটারার, সার্ভিস বয় রাখছেন অনেকেই।
ক্রিকেট-ব্যাডমিন্টন এখনকার পিকনিকে ব্যাক বেঞ্চে। “পিকনিক এখন পুরোপুরি ইভেন্টফুল।” বলছিলেন কলকাতার ইতালীয় এক কোম্পানির রিজিওনাল হেড কৌশিক বসু, “আমাদের অফিস পিকনিকে প্রচুর ইভেন্ট হয়। বাচ্চা, বড় সবাইকে নিয়ে। পেপার ডান্সটা খুব ইন্টারেস্টিং। গোল পেপারের ওপর কাপলের নাচ। যারা সবচেয়ে ছোট সাইজের পেপারের ওপর নাচতে পারে, তারাই জেতে।” নিজে পার্টিসিপেট করেন? “এই তো বছর দুয়েক আগে ‘মুন্নি বদনাম’য়ের সঙ্গে নাচতেই হল। তবে পিকনিক হলেই বা কি, ল্যাপটপ, মোবাইল তো খোলাই রাখতে হয়। ক্লায়েন্ট জ্বালিয়ে মারে মাঝে মাঝে। ফেলে ছড়িয়ে ফুর্তি করার দিনটা কি আর আছে! তবু বছরের ওই একটা দিন না গেলে ...।”
এ বছরের শুরুতে এমনই একটা পিকনিক-ক্রেজের নমুনা রাখলেন গায়ক অভিজিৎ। ফেসবুকে পোস্টিং করে মুম্বইয়ের বাঙালিদের ডেকে নিয়ে চড়ুইভাতি করলেন তিনি! দলবল নিয়ে বাসে করে পুণের ফার্ম হাউস। আলুর দম, আলু পটলের ডালনা, মুরগির ঝোল, নারকেল নাড়ু মিলে মেনু পুরো বাঙালি। শেষ দিকে ইংলিশ-ভিংলিশও। অন্ত্যাক্ষরি, ক্রিকেট থেকে পিএনপিসি, ডিজে ডান্স পার্টি।
তবে মুম্বইওয়ালা অভিজিৎ বলে নয়, এটাই তো আজকের বাঙালির বনভোজন।
বচ্ছরকার দিনে সেটা ‘মিস’ হলে চলে! অন্তত, ‘শ্রীমতী ভজহরি মান্না’র মতো ভুলে তো নয়ই।
হাতে রইল ছয়
অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
বাগানবাড়ি/৪
কলকাতা থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরেই মধ্যমগ্রামের বাদু। বাদু বাজারের পাশে রয়েছে নেপাল রায়ের বাগানবাড়ি। প্রায় নয় বিঘের প্রাচীর ঘেরা সেই বাগানবাড়ির মাঝখানেই রয়েছে বিশাল জলাশয়।
যোগাযোগ: ৯৮৭৪২৬৮২৭৪

মধ্যমগ্রাম থেকে সাত কিলোমিটার এগোলেই দত্তপুকুরে রয়েছে আরও কিছু বাগানবাড়ি। সন্তোষপুর মোড় থেকে ৩৪ ও ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়কের মধ্যে পরপর বাগানবাড়ি। এর মধ্যে গৌতম সাহার বাগানবাড়িতে ঢুকলে চোখে পড়বে নানা রকমের ফুল আর বাহারি গাছ। সুইমিং পুল থেকে শুরু করে নানারকমের আধুনিক সুযোগসুবিধাও।
যোগাযোগ: ৯৮৩০০৫৫২৩৫

বেহালা ঠাকুরপুকুরের ১১ কিমি দূরে বিবিরহাটে ‘একান্ত আপন’। ৩১০ কাঠা জমির ওপর ঘেরা এলাকা। ১টা কটেজ, ২টো সাজানো বেডরুম, ২বিঘের পুকুর, ৭টা বাগান। একদিনে একটাই দলকে দেওয়া হয়।
যোগাযোগ: ৬৬২৪ ৭৯৭৮

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় বিষ্ণুপুরে রয়েছে প্রাচীর ঘেরা বাগানবাড়ি ‘কমলা পিকনিক গার্ডেন’।
বিরাট ফুল বাগান, দোলনা, লন, বড় হল।
যোগাযোগ: ৯৮৩০০ ৮৬৫৫৬
গড়চুমুকের শান্ত ছায়ায়
ভাগীরথী ও দামোদর নদীর পাশে গড়চুমুক। শান্ত, নির্জন। নদীর ধারে গাছগাছালির ছাওয়ায় ঘেরা এখানকার জেলা পরিষদের বাংলো। বাংলো থেকে নদীর চরে নেমে যাওয়া যায় অনায়াসে। গ্রামের রাস্তায় সরল জীবনের আঁকেবাঁকে ঘুরে বেড়ালে মন স্নিগ্ধ হয়ে আসে। হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে উলুবেড়িয়া বা বাগনান স্টেশনে নেমে বাসে চলে যাওয়া যায়।
যোগাযোগ: ২৬৩৮ ৪৬৩৩
শরৎচন্দ্রের সামতাবেড়ে
যেতে হয় দেউলটি স্টেশনে নেমে হাইওয়ে পেরিয়ে উলটো দিকের রাস্তা ধরে। ওই রাস্তার বাঁ ধারে পড়ে সবুজে ঘেরা ‘নিরালা রিসর্ট’। বিশাল বাগান, সুইমিং পুল। পিছন দিকে চাষের ক্ষেত। কম্পাউন্ডের ভেতরে পিচঢালা পরিচ্ছন্ন রাস্তা। এখানে খাওয়া-থাকার প্যাকেজ নিয়ে পিকনিক করা যায়। এই রাস্তা ধরে আর কিছুটা এগোলেই রূপনারায়ণের পাড়ে সামতাবেড়ে শরৎচন্দ্রের বাড়ি। সংগ্রহশালাটি অনবদ্য।
যোগাযোগ: ৯৪৩১৬ ২০৯০১


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.