শনিবারের নিবন্ধ
দেখা হবে ভালবাসা, বেদনায়...
য়দানের পুড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপে দৃপ্ত ভঙ্গিতে ঢুকছেন তিনি। এক মাথা চুল, ধবধবে জুলফির সেই ‘যুবক’। সঙ্গে মৃণাল সেন, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বা দিব্যেন্দু পালিতদের মতো কেউ কেউ।
বইমেলায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলতে এই ছবিটাই কারও কারও মনের চিত্রশালায় অক্ষয় হয়ে আছে। দেড় দশক আগে সেই বইমেলাকে ফিনিক্স পাখির মতো জাগিয়ে তুলতে যখন মাঠে নেমেছিলেন সুনীল। এখন ছবিটা খুঁজছেন, মধ্য তিরিশের এক যুবক। ছোটবেলায় তাঁর জন্মদিনে বন্ধুদের নেমন্তন্নের লিস্টে ‘সুনীল-কাকু’ থাকবেনই থাকবেন। মনোযোগী লেখককে কাকাবাবু-সন্তুর কাণ্ডকারখানা নিয়ে কলকলিয়ে জ্ঞান দিত সেই খুদে ও তার বন্ধুরা।
আড়াই দশক বাদে বইমেলায় ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্যাভিলিয়ন’ সাজানোর দায়িত্বেও গুরুত্বপূর্ণ টিম-মেম্বার তিনি। আনন্দরূপ চট্টোপাধ্যায় ওরফে তাতার। একদা সুনীলের হরিহর-আত্মা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র। অ্যাড এজেন্সির পেশাদার তাতার বলছিলেন, বাইরে থাকবে ‘সুনীল-কাকু’-র বইয়ের প্রচ্ছদের কোলাজ। আর কাট-আউটে সন্তু, কাকাবাবু, নীলু কিংবা বন্দনাদিরা।
আগে বইমেলার ভিড়ে সব থেকে বড় জটলা দেখে সুনীল কোথায় বুঝে নিতে হত, এ বার জনসমুদ্রে ‘লাইট-হাউস’-এর মতো তিনি দাঁড়িয়ে থাকবেন। স্টলে মলাট-বন্দি নতুন সুনীল। তাঁর নামে বক্তৃতা, প্যাভিলিয়ন, প্রেক্ষাগৃহ! তাঁর স্মরণে অগুনতি সাহিত্য-আড্ডা, বড়-কুচো পত্রপত্রিকার সম্ভার! গোটা বইমেলাই তাঁর সাড়ে-তিন হাত ভূমি।
মন ভাল নেই
ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের আক্ষেপ তবু যাচ্ছে না। এই প্রথম সুনীলের কবিতা-গল্পে সাজানো সিডি-অ্যালবাম মিলবে বইমেলার মাঠে। কিন্তু সুনীলদাই নেই। সাত-আট মাস আগে এমন পরিকল্পনার কথা শুনে সুনীলদা কী যে খুশি হয়েছিলেন! ‘যা চেয়েছি, যা পাব না’—কবিতায় নীরাকে প্রবীণ কবির সংলাপ বলবার জন্য সুনীলকেই আবদার করেন ব্রততী। সে আর হল কই! ‘সুনীল সাগরে’ অ্যালবামে ওই কবিতাটি পরে তাঁর সঙ্গে রেকর্ড করেন বন্ধুু শ্রীকান্ত আচার্য। আকৈশোর সুনীল-পাঠের যাবতীয় নস্ট্যালজিয়া ঝালিয়ে নীরা ও ভালবাসাময় বেশ কয়েকটি চেনা কবিতা ও মন ছুঁয়ে যাওয়া অণু-গল্প বেছে নিয়েছেন ব্রততী। ব্রততীর মোবাইলের রিংটোনে তাঁরই স্বকণ্ঠে ‘কেউ কথা রাখেনি’ এখন অন্য মাত্রা পাচ্ছে।

কেউ কথা রাখেনি
‘কলকাতা লিটারারি মিট’-এর কর্ত্রী মালবিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও কথা না-রাখার বিষাদ ছুঁয়ে যাচ্ছে। বাংলার কবিকুলের কফি হাউস প্রজন্মকে নিয়ে সেখানে একটি আসরে শামিল হওয়ার প্রবল ইচ্ছে ছিল সুনীলের। মালবিকাকে সুনীলই বলেছিলেন ডেবোরা বেকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। ভারতের বিট-প্রজন্মকে নিয়ে ‘আ ব্লু হ্যান্ড’ বইটি লেখার সময়েই ডেবোরার সঙ্গে ভাব হয় সুনীলের। ’৬০-এর দশকের কলকাতায় অ্যালেন গিন্সবার্গের এক নম্বর চ্যালা সুনীল। লেখক অমিতাভ ঘোষের স্ত্রী ডেবোরা এ বার বইমেলায় আড্ডা দেবেন উৎপলকুমার বসু, দিব্যেন্দু পালিতদের সঙ্গে। থাকবেন দ্য জাপানিজ ওয়াইফ-খ্যাত গদ্যকার কুণাল বসুও। গত বার প্রথম লিটারারি মিট-এর উদ্বোধক সুনীলের নামে এ বার স্মরণ-বাসর। বাংলা, বাঙালি ও দুনিয়া নিয়ে আলাপচারিতা। চিন্ময় গুহের সঙ্গে সাহিত্যতত্ত্ববিদ বিদুষী গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। বুক সেলার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স গিল্ড-এর সুনীল-স্মৃতি বক্তৃতায় ‘বাংলা সাহিত্যের দিক্নির্দেশ’ দিতে ঢাকা থেকে আসবেন আনিসুজ্জামান। সুনীলের নামে গিল্ডের পুরস্কার পাবেন কোনও তরুণ কবি। এই সুনীল-পার্বণ বইমেলার নির্ঘণ্টে পাকাপাকি ঢুকে পড়ছে।
বইমেলার উত্তমকুমার
জীবনের প্রথম সুনীলহীন বইমেলাটা অবিশ্বাস্য ঠেকছে ভিন্ প্রজন্মের কৃত্তিবাসী বেলাল চৌধুরী বা শ্রীজাতর কাছে। ঢাকা থেকে বেলালও আসছেন সুনীলদাকে নিয়ে গিল্ড-এর সভায় যোগ দিতে। বেলালের স্মৃতির ভাঁড়ারে খালাসিটোলায় টইটম্বুর হয়ে বইমেলা-অভিযান। এবং আক্ষেপ, পাঠকরা সুনীলকে বন্ধুদের থেকে হাইজ্যাক করে নিত! সুনীলের অনুজপ্রতিম কবি সুবোধ সরকার বলছেন, বইমেলায় সুনীলদার সঙ্গে হাঁটা ব্যাপারটাই ছিল অসহ্য। জনতাকে সরিয়ে কৃত্তিবাসের স্টল থেকে গিল্ডের অফিস অবধি যেতেই এক ঘণ্টা! আর মেলা শেষ হলে অসমবয়সি বন্ধুদের সঙ্গে রাত ১২টা অবধি পানভোজনের আসর। খোলা গলায় গান গেয়ে বিশেষ ভাবে বইমেলার এক-একটি দিনের সমাপ্তি ঘোষণা করতেন সুনীল।
গিল্ড-কর্তা ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের মতে, সমরেশ বসুর পরে লেখককুলে এমন লেডি-কিলার কই! সে-দিক দিয়ে সুনীলই বইমেলার উত্তমকুমার। কোনও নবীন পাঠিকা বা তরুণী কবির সান্নিধ্যে সুনীল দাঁড়িয়ে দেখে, অনেক বন্ধুর গলায় ঈর্ষার ঝাপট। কিন্তু সুনীল অন্য রকম ভালবাসার গয়না নিয়ে জন্মেছিলেন। তাঁকে ভাল না-বেসেও পারতেন না চেনা-জানাদের চোদ্দো আনাই। ভক্তদের বোকা বানাতে বইমেলায় দুষ্টুমি করে সুনীলের নামে সই বিলোতেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথায়, পাঠকদের মুখোমুখি আড্ডায় বেশির ভাগ প্রশ্নের নিশানাই সুনীল।

তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি
বইমেলার সময়ে কলকাতায় থাকার জন্য অস্থির থাকত সুনীল।— বস্টন থেকে বললেন, সুনীল-জায়া স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়। আমেরিকায় ছেলের বাড়িতে গিয়ে কিছুটা অসুস্থ স্বাতী। তবু সুনীলের জন্যই বইমেলায় ফেরার অপেক্ষায়। কৃত্তিবাস-এর সুনীল-সংখ্যার জন্য লেখক তালিকা নিজে বাছাই করেছেন স্বাতী। ‘কৃত্তিবাসী’ দিব্যেন্দু পালিত বললেন, “নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ, যোগেন চৌধুরী, শীর্ষেন্দুর মতো ৫২ জন লেখক। থাকছে সুনীলের গ্রন্থ-পঞ্জি।” পাঠকের সুনীল-ভোজে আনন্দ পাবলিশার্সের স্টলে তাঁর শেষ উপন্যাস, শেষ নীললোহিত, শেষ কাকাবাবু, কবিতাসমগ্রের পঞ্চম খণ্ড, এখনও পর্যন্ত শেষ কাব্যগ্রন্থ এবং আনন্দমেলায় প্রকাশিত ছোটদের মহাভারত। প্রতিভাসে সাক্ষাৎকার-সমগ্র। সাহিত্যমে স্মৃতি-কথা। দে’জে ইতিহাসের গল্প।
সুনীল ও তাঁর সময়কে প্রদর্শনীতে মূর্ত করে রাখতেও কত চেষ্টা! বিরল ছবি, সুনীল-কণ্ঠে গান-কবিতা, তথ্যচিত্র সাজাতে ব্যস্ত সুনীল-সুহৃদ সৌমিত্র মিত্র। পাণ্ডুলিপি বা সৃষ্টির কাহিনি খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। একটি ছবিতে ছেলেদের ‘বসে আঁকো’-র আসরে বসে এক মনে আঁকছেন সুনীল। সঙ্গে লেখা, পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে স্বাধীনতার পোশাক পরা অস্ত্রধারীদের মহড়া। আমি একজন কিশোরের দিকে তাকাই, সে-ও স্বপ্ন দেখতে ভুলে যায়নি তো?
সুনীলের স্বপ্ন দু’চোখে মেখেই নতুন উড়ান কলকাতা বইমেলার।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.