প্যাকেটের নাম ‘বড়াওয়ালা’ কিংবা ‘লাল’। ভিতরের বান্ডিলটা ১০০০ টাকার জাল নোটের।
প্যাকেটের নাম ‘ছোটাওয়ালা’, ‘সবুজ’ কিংবা নিতান্ত সাধারণ ‘সব্জি’। ৫০০ টাকার জাল নোটের বান্ডিল।
অপরাধ জগতে এমনই সব ডাকনাম ভারতীয় জাল নোটের বান্ডিলের, যাতে একশো থেকে দু’শো নোট থাকতে পারে। এই ‘লাল’ বা ‘সবুজ’-এর চক্করে মালদহ এখন জাল নোটের কারবারিদের অন্যতম প্রধান গন্তব্য হয়ে উঠেছে, যা কেন্দ্র ও রাজ্যের গোয়েন্দা দফতর, পুলিশ এবং সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর দুশ্চিন্তার কারণ। গোয়েন্দাদের কাছে খবর, বছর তিনেক ধরে মালদহের ঘাঁটি থেকে দিল্লি, পুণে, রাজস্থান, হায়দরাবাদ, মুম্বই, চেন্নাইয়ে জাল নোট ছড়াচ্ছে একাধিক ‘এজেন্ট’। করাচি থেকে দুবাই, তাইল্যান্ড থেকে শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও বাংলাদেশ-সহ নানা জায়গায় বসে ওই ‘এজেন্ট’দের নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সন্দেহ করা হচ্ছে এই চক্রের আসল মাথা দাউদ ইব্রাহিম, ছোটা শাকিলের মতো ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ অপরাধীরা।
গ্রামের মহিলা, পড়ুয়া, নাবালকদেরও ওই কারবারে সামিল করার প্রবণতা বাড়ছে। গত বছরই মালদহ থেকে এই চক্রে জড়িত অভিযোগে যে ১৮৬ জনকে ধরা হয়েছে, তাদের মধ্যে জনা ২৫
মহিলা। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর
ডিআইজি (মালদহ) শ্রী মধুকর জানান, স্রেফ মহিলা নোট পাচারকারীদের ঠেকাতে মালদহে নতুন মহিলা জওয়ান নেওয়া হয়েছে। |
পরিস্থিতি সামলাতে রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশে মালদহ জেলা পুলিশ বিশেষ ‘টাস্ক ফোর্স’ গড়ে আসরে নেমেছে। গত বছরই মালদহ থেকে উদ্ধার হয়েছে প্রায় ২ কোটির জাল নোট। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার কথায়, “পুলিশ বিশেষ টাস্ক ফোর্স গড়ে সাফল্য পাচ্ছে।” রাজ্যের নারী ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী সাবিত্রী মিত্রও (যিনি জেলার বিধায়কও) মানছেন, “জেলার সীমান্ত এলাকায় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় আরও গতি আনতে হবে, না হলে মহিলা ও নাবালক-নাবালিকাদের ভুল পথে যাওয়া আটকানো সহজ হবে না।” তবে পরিস্থিতির জন্য তিনি দুষেছেন রাজ্যে বাম-জমানার ‘অনুন্নয়ন’কে।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতর সূত্রের খবর, গত এক বছরে দিল্লি, মুম্বই, পুণে, চেন্নাই, হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরুতে জাল নোট-সহ শতাধিককে ধরা হয়েছে। তার মধ্যে মালদহের বাসিন্দা অন্তত ৫০ জন। ১০ জন আবার নাবালক-নাবালিকা। যেখানে দিনভর বিড়ি বেঁধে ৬০ টাকা মজুরি মেলে, সেখানে ছোট্ট একটা ‘লাল’ বা ‘সবুজ’-এর প্যাকেট আঁচলে কিংবা অন্তর্বাসে নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিলেই মিলতে পারে ৫০০ থেকে হাজার টাকা। এমন টোপেই অন্ধকারের দুনিয়ায় ঢুকছেন মহিলারাও। ওই কারবারে মালদহের হাজার দু’য়েক মানুষ জড়িয়ে পড়েছেন বলে অনুমান করা হচ্ছে।
এই অপরাধ চক্রের শিকড় মালদহে কতটা ছড়িয়েছে সম্প্রতি তা টের পেয়েছেন ‘ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি’ (এনআইএ)-র অফিসারেরাও। ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ সূর্য জামালকে ধরতে কালিয়াচকে গিয়ে গ্রামবাসীর বাধার মুখে পড়েন তাঁরা। গ্রামের ছোট ছেলেমেয়ে, মহিলাদের একটি বড় অংশ রাস্তায় শুয়ে গাড়ি আটকে দেয়। ইট-পাথর ছোড়ে। বোমাবাজিও হয়। সে যাত্রায় এনআইএ-র অফিসারেরা পিছু হটেন। পরে ডিসেম্বরের গোড়ায় জেলা পুলিশ সাদা পোশাকে অভিযান চালিয়ে সূর্যকে ধরে।
সূর্যের গ্রেফতারের সূত্রেই জাল নোটের জগতে মালদহের নাম প্রথম সারিতে কেন এল, তা কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। ধৃতকে জেরা করে পাওয়া তথ্য বলছে, রাজস্থান, পাঞ্জাব, জম্মু-কাশ্মীরের পাক সীমান্তে সেনা ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর তৎপরতায় জাল নোট পাচার তুলনায় কম হচ্ছে। ভারতের বিভিন্ন বন্দর লাগোয়া সমুদ্রপথেও নজরদারি তীব্র হয়েছে। নেপালেও জাল নোট নিয়ে সরকারি ধরপাকড় বাড়ছে। তাই জাল নোটের কারবারিদের নজরে পড়ে মালদহ। পুলিশ ও গোয়েন্দারা মনে করছেন, জেলার অন্তত ৫০ হাজার শ্রমিক নানা কাজের সূত্রে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কর্মরত। তাঁদের একাংশকে কাজে লাগানোর ছক কষে এই চক্র। কালিয়াচকের মতো সীমান্ত ঘেঁষা এলাকার বাসিন্দাদের একাংশের অপরাধপ্রবণতার ইতিহাসও দুষ্কৃতীদের উৎসাহ বাড়ায়। মালদহের সঙ্গে গোটা দেশের ট্রেন সংযোগ ভাল থাকায়, জাল নোট ছড়াতে সুবিধা হবে বলেও ধরে নিয়েছিল চক্রটি। প্রায় একই কারণে তাদের নজরে রয়েছে মুর্শিদাবাদ, কোচবিহারও। মালদহের পুলিশ সুপার জয়ন্ত পাল বলেন, “এখন জাল নোটের কারবারে যুক্তদের ১০-১২ শতাংশ মহিলা ও নাবালক। এখনই সব দফতর মিলে সীমান্ত এলাকায় সামগ্রিক উন্নয়নের গতি না বাড়ালে এই সংখ্যা বাড়তে পারে। পুলিশ একক ভাবে তা ঠেকাতে পারবে না।” |