তিলজলায় গণপিটুনির ঘটনায় ধরা পড়েছে এলাকায় অবৈধ নির্মাণে অভিযুক্ত দুই প্রোমোটার। সম্প্রতি ওই সব এলাকায় পুলিশি অভিযান চালিয়ে কিছু বেআইনি নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তার প্রেক্ষিতেই পুলিশের এখন অনুমান, ছেলেধরার গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনি এবং বাঁচাতে এসে পুলিশের আক্রান্ত হওয়ার পিছনে কাজ করছে বেআইনি নির্মাণের প্রোমোটারদেরই কোনও দুষ্টচক্র। পুলিশের উপরে আক্রোশ মেটাতে তারাই ছক কষে গুজব ছড়িয়ে কাজ হাসিল করছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সন্দেহটা দানা বেঁধেছিল আগেই। মঙ্গলবার রাতে একবালপুরের ঘটনার পরে লালবাজারের কর্তারা নিশ্চিত, নির্দিষ্ট একটি জায়গা থেকে পরিকল্পনা করেই ছড়ানো হচ্ছে শিশুচুরির গুজব। আর সেই ঘটনার ‘ফাঁদে’ পড়েই আক্রান্ত হচ্ছে পুলিশ। লালবাজারের এক কর্তা জানিয়েছেন, সব ক’টি ঘটনাতেই অপরাধের কৌশল এক। অর্থাৎ, গুজব রটিয়ে এক জনকে মারধর করা হচ্ছে। বাঁচাতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছে পুলিশ। শুধু তা-ই নয়, মহিলা, বৃদ্ধ-সহ স্থানীয় বাসিন্দারা চড়াও হচ্ছেন পুলিশের উপরে। এই ফাঁকেই চম্পট দিচ্ছে মূল অপরাধীরা।
তিলজলার এক গণপিটুনির ঘটনায় বাইপাস অপারেশন হওয়া দুই বৃদ্ধ পুলিশের উপরে চড়াও হয়েছিলেন। একবালপুরে মহিলাদের ঠেকাতে নামাতে হয় র্যাফের মহিলা কর্মীদের। এই সব দেখেই পুলিশকর্তারা নিশ্চিত, কোনও নির্দিষ্ট চক্র পরিকল্পনা মাফিক শহর জুড়ে এমন ঘটিয়ে যাচ্ছে।
কারা রয়েছে এর পিছনে? পুলিশের একটি অংশ বলছে, শনিবার রাতে অভিযান চালিয়ে তিলজলার গণপিটুনির ঘটনায় ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। যার মধ্যে স্থানীয় তোলাবাজ, অস্ত্র কারবারি, সাট্টার বুকিরা ছিল। ওই ঘটনাতেই পরে দু’জন প্রোমোটারও ধরা পড়ে। এদের জেরা করে জানা গিয়েছে, আরও কয়েক জন প্রোমোটারের নাম। তদন্তকারীরা বলছেন, অভিযুক্ত প্রোমোটারদের বিরুদ্ধে ওই এলাকায় বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ ছিল।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা বলেন, “সম্প্রতি ওই এলাকাগুলিতে অভিযান চালিয়ে বেআইনি নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে কিছু লোক সুযোগ বুঝে আক্রোশ মেটাচ্ছে। এ সবই তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।” পুলিশ সূত্রের খবর, ওই সব এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক মদতে বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ ছিল। ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতে থানার ওসিদের বদলিও হয়েছে।
শহরের বুকে পরপর এমন ঘটনায় সন্দেহের তির যেমন দুষ্ট প্রোমোটার চক্রের দিকে, তেমনই কোনও বড় ধরনের অপরাধী এর সঙ্গে জড়িত কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা। লালবাজারের একাংশ বলছে, ২০০৭ সালের নভেম্বরে তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে শহর জুড়ে তাণ্ডব চালায় একদল দুষ্কৃতী। তাদের ছোড়া বোতলের আঘাতে জখম হন কলকাতা পুলিশের বর্তমান যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম। এলাকা শান্ত করতে শেষ পর্যন্ত সেনা নামে শহরের রাস্তায়। সে দিন কেন পুলিশ আরও কঠোর হয়নি, সে প্রশ্ন উঠেছিল। পুলিশকর্তারা বলছেন, গুলি চালানোর মতো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ফাঁদ পেতেছিল দুষ্কৃতীরা। তাতে পা দিলে গণ্ডগোল আরও বড় হতে পারত। সে কারণেই শুধু লাঠি হাতে দুষ্কৃতীদের মোকাবিলা করেছিলেন পুলিশকর্মীরা। পরবর্তী কালে তদন্তে জানা গিয়েছিল, জঙ্গি নেতা আমির রেজা খান করাচিতে বসে সে দিনের ঘটনার পুরো পরিকল্পনা করেছিল।
গণপিটুনির ঘটনাতে এখনও এমন কোনও শক্তির হাত থাকার প্রমাণ পাননি গোয়েন্দারা। কে বা কারা এই ঘটনা ঘটাচ্ছে, তা-ও জানতে পারেননি পুলিশকর্তারা। তবে লালবাজারের আশ্বাস, এমন ঘটনা রুখতে তিন দফা ব্যবস্থা নিয়েছেন তাঁরা। কী রকম?
পুলিশ জানায়, থানাগুলিতে টহল বাড়বে। বর্তমানে যেখানে সাত-আটটি টহলদার দল রয়েছে, তা ১১-১২টি করা হবে। গোয়েন্দা বিভাগের গুন্ডাদমন শাখার বাছাই করা অফিসারদের একটি দল এ নিয়ে খোঁজখবর করছে। তাঁদের সাহায্য করছে স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)। এ ছাড়া, কয়েক জন ধর্মগুরুর সঙ্গেও কথা বলছে পুলিশ। এক পুলিশকর্তা বলেন, “তাঁরা যাতে সাধারণ মানুষকে আইনশৃঙ্খলা হাতে তুলে নিতে নিষেধ করেন, সে নিয়ে অনুরোধ করা হচ্ছে।” এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার ফের শিশু-চোর সন্দেহে মারধর করা হয় এক মহিলাকে। দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ সাউথ পোর্ট থানার কোলবার্থ রোডে ঘটনাটি ঘটে। এক মহিলাকে বেশ কিছু লোক মারধর করছে দেখে অন্যরা থানায় খবর দেন। সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিতে বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছন সাউথ পোর্ট থানার ওসি। পুলিশ জানিয়েছে, বড় কিছু হওয়ার আগেই মহিলাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসা হয়। আয়েশা বিবি নামে ওই মহিলার বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পেরেছে ওই মহিলা ভিক্ষা করতে করতে ওই এলাকায় এসে পড়েন। |