|
|
|
|
জমি সমস্যা এড়িয়ে মমতার সুরেই আশ্বাস রাজ্যপালের |
জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় • হলদিয়া |
মুখ্যমন্ত্রী জবাব দেননি। খোলসা করেনি শিল্পমন্ত্রী। হলদিয়ায় ‘বেঙ্গল লিডস’-এর শেষ দিনে শিল্পমহলকে ধন্দে রাখলেন রাজ্যপালও। জমি অধিগ্রহণ, শহরাঞ্চলে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন, অন্যত্র সিলিং-অতিরিক্ত জমি কেনার সমস্যার প্রসঙ্গ এড়িয়ে সরকারের সুরেই তিনি গাইলেন শিল্প সম্মেলনের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে।
রাজনীতির কারবারিদের অনেকের মতে, সরকারের অভিভাবক হিসেবে কাজ না-করে গোড়া থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখানো পথে হাঁটছেন রাজ্যপাল। মাঝে দু’পক্ষের সম্পর্কে সামান্য চিড় ধরে। যার পরিণতি ‘রাজ্যে গুন্ডারাজ চলছে’, এমন বিস্ফোরক মন্তব্য। যার জেরে পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের তাঁকে পাল্টা হলুদ কার্ড দেখান। কিন্তু সুব্রতবাবুকে সরকারের মুখপাত্রের পদ থেকে সরিয়ে এম কে নারায়ণনের সঙ্গে তড়িঘড়ি সন্ধি করে ফেলেছেন মমতা।
নারায়ণন এ দিন ‘শিল্পমন্ত্রীর পৌঁছে দেওয়া বক্তব্য’ পাঠ করছেন দেখে হতাশ শিল্পমহলে কানাঘুষো, ‘সন্ধি তো দেখছি জোরদার হয়েছে’। আর উচ্ছ্বসিত শিল্পমন্ত্রীর মন্তব্য, “সংবাদমাধ্যম যতই অপচেষ্টা করুক, আমাদের সম্পর্ক অটুট রয়েছে।”
কিন্তু ২৫ কোটি টাকা খরচ করে ‘বেঙ্গল লিডস’-এর আসর বসিয়ে শিল্পমহলের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক জোরদার হল কি? এই প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক নয় বলেই অধিকাংশ লগ্নিকারীর মত। কারণ, তাঁদের যা উদ্বেগ, তার কোনও কিছুরই নিরসন হল না এই আড়াই দিনের শিল্পযজ্ঞে।
প্রথম প্রশ্ন, জমি আসবে কোথা থেকে? শিল্পের জন্য জমি নিতে অনীহা মুখ্যমন্ত্রীর। লগ্নিকারীদের তিনি ল্যান্ড ব্যাঙ্ক দেখাচ্ছেন। এ দিন রাজ্যপালও বললেন, “শুনলাম, ৬০ হাজার একর জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। শহর এবং গ্রামীণ এলাকায় সরকারের জমির ব্যাঙ্কও তৈরি করা হচ্ছে।” পার্থবাবু কিন্তু জানাচ্ছেন, ওই ৬০ হাজার একর জমির সবটা ব্যবহারযোগ্য নয়। |
|
বেঙ্গল লিডসে রাজ্যপালের সঙ্গে আলোচনায় শিল্পমন্ত্রী। —নিজস্ব চিত্র |
রাজ্যপালের বক্তব্য, সরকার ও শিল্পমহল, দু’পক্ষকেই সব দিক বিবেচনা করে জমি নিতে হবে।
কারণ, কৃষিজমি নেওয়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কঠিন। নারায়ণনের কথায়, “জমি জোগাড়ে সরকার এবং লগ্নিকারীর যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন।” শিল্পমহলের একাংশের মতে, জমি অধিগ্রহণে সরকারের ভূমিকা থাকার কথাই বলতে চেয়েছেন তিনি। যা মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থানের বিরোধী। কিন্তু শিল্পমহলের অন্য অংশ বিষয়টি সে ভাবে দেখতে নারাজ। তাঁরা ‘কৃষিজমি নেওয়া কঠিন’ এই অংশে জোর দিয়ে বলছেন, জমির জন্য রাজ্যের উপরে চাপ সৃষ্টি না-করার কথাই প্রকারান্তরে বলেছেন রাজ্যপাল।
শিল্পমন্ত্রী অবশ্য বলছেন, “জমি নেই বলে শিল্প গড়া যাচ্ছে না, এই অভিযোগ ডাহা মিথ্যা। জমির অভাব নেই। আর জমি জোগাড়ে সরকার সাহায্য তো করছেই। রাজ্যপাল সে কথাই বলতে চেয়েছেন।”
লগ্নিকারীরা নিজেরাই যদি জমি কিনবেন, তা হলে সিলিং-অতিরিক্ত জমির ক্ষেত্রে উদ্ভট নীতি (ভূমি সংস্কার আইনের ১৪ ওয়াই ধারা) কেন নেওয়া হচ্ছে, সেটাও প্রশ্ন। এখন অতিরিক্ত জমি কিনলে তা সরকারকে দিয়ে দিতে হয়। তার পর সরকার লগ্নিকারীর আবেদন বিবেচনা করে সেই জমি তাঁকে লিজে দেয়। অর্থাৎ নিজের কেনা জমি ফের সরকারকে টাকা দিয়ে লিজে নিতে হয় লগ্নিকারীকে। লিজ দেওয়া হবে কি না, সেটাও আবার সরকারের বদান্যতার উপরই নির্ভর করছে।
এই সব প্রশ্নের সদুত্তর রাজ্যপালের ভাষণে ছিল না। তিনি শুধু বলেন, “সরকার অতিরিক্ত জমি হাতে রাখার জন্য আইনের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করেছে। আরও কিছু পরিবর্তন হতে পারে।” শিল্পমন্ত্রী বলেছেন, “শিল্পের প্রয়োজনে যদি অতিরিক্ত জমি লাগে তা হলে মুখ্যমন্ত্রী এক কথায় তা
ছেড়ে দেবেন।” শিল্পপতিরা কিন্তু বলেছেন, সরকার জমি অধিগ্রহণ করবে না। আবার জমি কিনলে কতটা দেবে আর কতটা রেখে দেবে, তা-ও ঠিক করবে। তা হলে কোন ভরসায় এগোবেন তাঁরা!
প্রশ্ন থাকছে শহরাঞ্চলে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন নিয়েও। শিল্পপতিদের বক্তব্য, পৃথিবীর আর কোথাও এমন আইন নেই। কেন্দ্রও এই আইন তুলে দেওয়ার শর্তেই জওহরলাল নেহরু আরবান রিনিউয়াল মিশন প্রকল্পে বরাদ্দের নীতি ঠিক করেছে। এই শর্ত না-মানায় পশ্চিমবঙ্গ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ পাচ্ছে না। রাজ্যের নগরোন্নয়ন দফতরের এক কর্তা বলেন, “সরকারের যুক্তি সিলিং তুলে দিলে বড়লোকদের হাতে জমি চলে যাবে। গরিব মানুষ গৃহহারা হবেন। কিন্তু সরকারের কর্তারা এটা বুঝতে পারছেন না, এর ফলে কেন্দ্র থেকে যে কয়েক হাজার কোটি টাকা মিলবে, তা বস্তি উন্নয়নেই লাগানো যেত।”
নারায়ণন এ দিন বলেন, এমন শিল্প সম্মেলনে রাজ্যপাল সাধারণত আসেন না। তিনি এসেছেন, শুধু মুখ্যমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রী আমন্ত্রণ করেছেন বলে নয়, বাংলায় এবং তার ভবিষ্যতে বিশ্বাস করেন বলে। লগ্নিকারীদের তাঁর পরামর্শ, “একটু ধৈর্য ধরুন।” আর তৃপ্ত শিল্পমন্ত্রী বললেন, “আমাকে আর দু’টো বছর সময় দিন। সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেব।” |
|
|
|
|
|