ফের চোখে জল আদিবাসীদের দিদিমণি’র
শ বছর আগে স্কুলে বদলি হয়ে প্রথম দিন পরিস্থিতি দেখে চোখে জল এসে গিয়েছিল এলাকার ‘দিদিমণি’। বুধবার দুপুরেও তাঁর চোখে কোণে বারবার জল আসছিল। সেবার কেঁদেছিলেন তরাই-এর চা বাগানের কোলে ভাঙা তিনটি ঘর, চুরি হয়ে যাওয়া স্কুল বারান্দার চাল, হতদরিদ্র গুটি কয়েক ছেলেমেয়েগুলি দেখে। এবার কাঁদলেন এক দশক ধরে নিজের স্কুলের ‘পরিবর্তনের’ সঙ্গী হতে পেরে।
মহিলা স্বাক্ষরতা, প্রতিবন্ধীদের লেখা শেখানো, দোতলা বাড়ি, দোলনা, স্লিপার-সহ পার্ক, শৌচাগার, অডিটোরিয়াম, মিডডে মিলের আলাদা ঘর, সিড়ির স্টিলের রেলিং মত কী নেই নকশালবাড়ি ব্লকের সেবদুল্লা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। গত বছর প্রথম মাধ্যমিক পাশ দুই ছাত্রী এই স্কুলেরই। যা হার মানাতে পারে যে কোনও যে কোনও শহরের হাইস্কুলকেও। আর যার পুরো কৃত্বিত্বই এলাকার দিদিমণি তথা চায়না পাল কুণ্ডুকেই দিচ্ছেন তাঁর সহকর্মী থেকে শুরু করে স্থানীয় আদিবাসী বাসিন্দারা।
তাঁরা জানাচ্ছেন, গত দুই বছরে সর্বশিক্ষা মিশনের প্রায় ১৬ লক্ষ টাকায় স্কুলের উন্নয়ন হয়েছে ঠিকই। কিন্তু গভীর রাত অবধি মহিলা হয়েও গ্রামের মহিলাদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ছাদ ঢালাই করানো, নিজে হাতে নানা শিশু শিক্ষার বিষয় দিয়ে গ্রিল-দোতলার সিড়ি-অডিটোরিয়াম সাজানো, গ্রামে ঘুরে ঘুরে বাচ্চাদের স্কুলে আনাটা দিদিমণি ছাড়া সম্ভব হত না। এমন কী, এদিন স্কুলের নতুন ভবনের উদ্বোধনে গিয়ে সব দেখে, শুনে মাইক হাতে নিয়ে প্রকাশ্যে দিদিমণিকে প্রণাম জানালেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবও। শুধু তাই নয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে অনুরোধ করে স্কুলটি ‘মডেল’ স্কুল হিসাবে ঘোষণার কথাও জানিয়ে দেন গৌতমবাবু।
নয়া ভবন উদ্বোধনের পর সেবদুল্লা জোত প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
আপ্লুত মন্ত্রী স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীদের জুতো, সমস্ত বেঞ্চ-টেবিল, মিডডে মিলের বড় ঘর উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তৈরি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। গৌতমবাবু’র কথায়, “আমি অভিভূত। এই রকম প্রত্যন্ত গ্রামে কী স্কুল হয়েছে এই স্কুলকে না দেখলে বোঝা যাবে না। আমি নিজেই জানতাম না। সবাইকে বলব, একবার সেবদুল্লা প্রাথমিক স্কুলে আসতে।” পাশাপাশি, স্কুলের ছাত্রী তথা এলাকার প্রথম মাধ্যমিক পাশ দুটি মেয়েকে ২৮ জানুয়ারি শিলিগুড়িতে মুখ্যমন্ত্রীর হাত দিয়ে ১০ হাজার টাকা করে উচ্চ শিক্ষার জন্য দেওয়া হবেও মন্ত্রী জানিয়েছেন। শুরুটা কিন্তু এত সহজ ছিল না। নকশালবাড়ি সেবদুল্লা জোত সারা দেশে পরিচিত নকশাল আন্দোলন, প্রয়াত নকশাল নেতা কানু সান্যালের ভিটে হিসাবে। বাম আমলে ১৯৭৯ সালে এই প্রাথমিক স্কুলের জন্ম। তিনটি অ্যাডবেস্টারের চালের ঘর, এক চিলতে বারান্দা দিয়ে শুরু। ছাত্র সংখ্যা মেরেকেটে ২৫। স্কুল থাকলেও এলাকার আদিবাসী পরিবারের কচিকাঁচারা অভ্যস্ত ছিলেন মাঞ্ঝা নদীতে পাথর তোলা, লাগোয়া বাগানগুলিতে কাজ করতে। এই ভাবেই চলেছে স্কুল। ২০০২ সালে চায়নাদেবী নকশালবাড়ি বেঙাইজোত থেকে বদলি হয়ে এই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হন। সঙ্গী বলতে একমাত্র শিক্ষক অরিজিৎ রায়। ছাত্রছাত্রী ৩৫ জন। তাও অনিয়মিত। সেই থেকে পথ চলা শুরু। চায়নাদেবীর কথায়, “বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজেদের টাকায় ফর্ম ছাপিয়ে ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করেছি। নদী থেকে শিশুদের ধরে এনেছি। একটি প্রতিবন্ধী শিশু ছাড়াও এলাকার মহিলাদের লেখা শিখিয়েছি। ১০ বছর কোথা দিয়ে চলে গেল টেরই পেলাম না। এখন বিশদ্ধ পানীয় জল, সীমানা প্রাচীর এবং গাছ দিয়ে স্কুলে আরও ভরে দেওয়ায় আমার লক্ষ্য।” আবেগ তাড়িত হয়ে আরও বললেন, “এই স্কুলই আমরা পরিবার, আমার জীবন। সমস্ত স্তরের সাহায্য পেয়েছি। আরও ৮ বছর চাকরি রয়েছে। রাজ্যের অন্যতম প্রাথমিক স্কুল হিসাবে এর নাম নথিভুক্ত করানোই আমার লক্ষ্য।” হাতিঘিসা বাজার থেকে মেরেকেটে এক কিলোমিটার প্রায় এক একর জায়গার উপর স্কুলটি। বর্তমানে ছয়জন প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রী-সহ স্কুলের বর্তমান ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ২৫৫ জন। একজন পার্শ্ব শিক্ষক-সহ ৭ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন। স্কুল ‘গড়া’র কাজে তাঁকে যাঁরা সাহায্য করেছেন, সেই বাসিন্দাদের এদিন পুরষ্কৃতও করেছেন চায়নাদেবী।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.