প্রবন্ধ ...
মাথায় কাঁটার মুকুট, মহামহিম বেচারা রাজ্যপাল
কাশ্মীর থেকে কেরল, গুজরাত থেকে বঙ্গ, সব রাজ্যে তাঁদের রাজকীয় উপস্থিতি। বছরে কোটি কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ (এই রাজ্যেই এখন পাঁচ কোটির বেশি) তাঁদের খাতে। সেপাই-সান্ত্রি-আমলা-অমাত্য-প্রোটোকল দিয়ে ঘেরা তাঁদের সরকারি ঠিকানা রাজভবন। সকল রাজ্যের রাজধানী শহরে তা অন্যতম সম্ভ্রমসূচক দ্রষ্টব্য। সেই বাড়ির বাসিন্দা হতে পারা যে বিশেষ গরিমার বিষয়, এমন ভাবনা খুব অমূলক নয়।
কিন্তু দিনে-দিনে, কালে-কালে রাজভবন নিবাসী এই পদাধিকারীরা যে ভাবে বিতর্কের শিকার হচ্ছেন, যে ভাবে কটু মন্তব্য ও কটাক্ষে বার বার জর্জরিত হয়েও অনেক কিছুই ঢোক গিলে হজম করতে হচ্ছে তাঁদের, তার পরে এই পদটিকে ‘বেচারা’ ছাড়া কী-ই বা বলা যায়!
হাতের কাছে এম কে নারায়ণনের কথাই ধরা যাক। দেশের গোয়েন্দা প্রধান এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার মতো পদ সামলে আসা এই প্রাক্তন আই পি এস অফিসার পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হয়েছেন তিন বছর আগে। রাজ্য রাজনীতিতে তখন এক ক্রান্তিকাল। সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রাম-কাণ্ড ঘটে গিয়েছে। ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফল থেকে সি পি এমের পতন এবং মমতার আগমনবার্তা মোটামুটি স্পষ্ট। রাজ্যে বইছে পরিবর্তনের বাতাস।
কিন্তু রাজভবনে সেই বাতাস পৌঁছক, কোনও নতুন মুখ আসুক, তৃণমূল নেত্রী এবং তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে তা মন থেকে চাননি। তিনি বরং খুশি হতেন, কেন্দ্র যদি গোপালকৃষ্ণ গাঁধীকেই আরও এক দফা রাজ্যপাল রেখে দিত। কারণ নন্দীগ্রামে গুলিচালনা নিয়ে গোপালকৃষ্ণের কঠোর বিবৃতির পর থেকে তাঁর সঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের সম্পর্ক ক্রমশ তলানিতে চলে গিয়েছিল। তাঁকে তৃণমূলের পতাকা ধরে রাজনীতিতে নামার পরামর্শও দিয়েছিলেন আলিমুদ্দিনের কতিপয় নেতা।
হয়তো ‘বেচারা’ পরিস্থিতিতে মুখ বুজে থেকেছেন গোপালকৃষ্ণ গাঁধী। তবে ঘনিষ্ঠমহলে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, রাজ্যপাল নামক এই ‘বিলাসের ফাঁস’ আর পরতে চান না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আরও কিছু কারণ। সব মিলিয়ে নির্দিষ্ট কার্যকাল শেষ হতেই সরে যান গোপালকৃষ্ণ। আসেন নারায়ণন। সি পি এম তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল। সীতারাম ইয়েচুরি বলেছিলেন, রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেই কেন্দ্র তাঁকে পাঠিয়েছে।
রাজ্যপাল পদের মর্যাদা এবং সাংবিধানিক লক্ষ্মণরেখা না বোঝার মতো অবিবেচক নারায়ণন নন। মমতার নেতৃত্বে ‘পরিবর্তনের সরকার’ শপথ নিয়েছে তাঁর কাছে। সরকারের সঙ্গে ‘সঠিক’ সম্পর্ক রাখার ব্যাকরণে ভুল না করার বিষয়েও তিনি সতর্ক থেকেছেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মমতাও বলেছিলেন, কলকাতায় থাকলে প্রতি শুক্রবার রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে সরকারের কাজকর্ম সম্পর্কে অবহিত করবেন।

অমোঘ আপস? মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপাল। ছবি: সুদীপ আচার্য
শুক্রবার এখনও আসে। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপাল দুজনেই শহরেও থাকেন অনেক সময়। কিন্তু সাপ্তাহিক সৌজন্য সাক্ষাতের নিয়মরক্ষা আজ আর তেমন চোখে পড়ে না। উল্টে রাজ্যপালকে মহাকরণে চিঠি লিখে বলতে হয়, সরকারের কাছে রাজভবন কোনও কিছু জানতে চাইলে জবাব দিতে গড়িমসি করা হচ্ছে। জবাব যা আসে, তা-ও অনেক সময় দায়সারা। গুন্ডাগিরি নিয়ে মুখ খোলার পরে এখন তো তাঁকে ‘লাল কার্ড’ দেখার হুমকিও শুনতে হল।
মহামহিম বেচারা রাজ্যপাল!
ভারতের মতো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় দেশের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সংযোগরক্ষার উদ্দেশ্যে রাখা হয়েছিল রাজ্যপালের পদ। নানা ভাষা, নানা মতের ভারতবর্ষে রাজ্যপালদের স্বীকৃত ভূমিকা হল রাষ্ট্রপতির চোখ-কান হিসেবে কাজ করা। কিন্তু কালক্রমে রাজ্যপালদের নিয়োগ হয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক। রাষ্ট্রপতি রাজ্যপালদের নিয়োগকর্তা। আবার রাষ্ট্রপতিকে চলতে হয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সুপারিশ মেনে। দুইয়ে দুইয়ে চারের অঙ্কে রাজ্যপালদের বাছাই হয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার ইচ্ছা অনুযায়ী। সোজা কথা, রাজ্যপালেরা ‘কেন্দ্রের এজেন্ট’ তকমা বুকে লাগিয়ে রাজভবনে আসেন। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, তাঁদের সঙ্গে রাজনৈতিক বিবাদের ক্ষেত্র তাই সর্বদাই উন্মুক্ত।
একটা সময় ছিল যখন বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচিত সরকার ভেঙে দেওয়ার কাজে রাজ্যপালদের ব্যবহার করা হত আকছার। অবশ্যই কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছানুযায়ী। ইন্দিরা গাঁধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৭, এগারো বছরে ৩৯ বার একের পর এক কংগ্রেস-বিরোধী রাজ্যে সরকার ভেঙে দিয়ে রাজ্যপালের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়েছে। তার মধ্যে যুক্তফ্রন্ট আমলের পশ্চিমবঙ্গও আছে। তখনকার রাজ্যপাল ধর্মবীরের সঙ্গে সেই সময়ের প্রধান সরকারি দল সি পি এমের সংঘাত এক ইতিহাস। ১৯৭৭-এ জনতা পার্টি দিল্লির ক্ষমতায় এসেও দু’বছরের মধ্যে ১১ বার বিভিন্ন রাজ্যে একই কাজ করে।
১৯৮০’তে ইন্দিরা ক্ষমতায় ফিরলেন, কিন্তু রাজ্যপালদের কাজে লাগিয়ে সরকার ভাঙার ধর্ম বদলাল না। এ কাজে তাঁর শেষ বড় ধাক্কা বোধহয় ১৯৮৪’তে রাজ্যপাল রামলালকে দিয়ে অন্ধ্রে এন টি রাম রাওয়ের সরকারকে ফেলার চেষ্টা। কংগ্রেসের আর এক প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের আমলেও এক বার এমনই এক চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৯৪ সালে কর্নাটকের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এস আর বোম্মাই বনাম ভারত সরকারের সেই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের পর থেকেই সংবিধানের ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে সরকার ভেঙে দেওয়ার প্রবণতা কমে আসে, এখন সে রীতি প্রায় নেই বললেই চলে।
পারতপক্ষে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সংঘাত এড়ানো বা সম্পর্ক খারাপ না হওয়ার দিকেই গুরুত্ব দেন এখনকার অধিকাংশ রাজ্যপাল। কোথাও একটু ‘বেফাঁস’ কিছু হয়ে গেলে তাকে ‘সৌজন্যের খাতিরে’ দ্রুত মেরামত করার তাগিদটাও অনেক রাজ্যপালের কাজে স্পষ্ট। দু’চার দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এক মঞ্চে বসে যেমন করেছেন এম কে নারায়ণন।
তবু আজও পান থেকে চুন খসলেই যে কোনও রাজ্যে বিরোধী দলগুলি সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে রাজ্যপাল নামক সেই ‘কেন্দ্রের এজেন্ট’-এর কাছেই ছুটে যায়। বহু ক্ষেত্রে দাবিও করে সরকার ফেলে দেওয়ার। যদিও এ সব নিছকই এক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। রাজ্যপাল নামক ব্যক্তিটির প্রত্যাশিত ভূমিকা এ ক্ষেত্রে অনেকটা সিঁদুর-চন্দন-লেপা পাথরের দেবতার মতো। নিশ্চল, নির্বিকার। শুধু মনে করা হয়, তিনি ‘জাগ্রত’। বড়জোর ঘাড় নেড়ে বা মুচকি হেসে বলতে পারেন, “আচ্ছা, আমি দেখব। আই উইল লুক ইনটু...”
মহামহিম বেচারা রাজ্যপাল!
যত যা-ই হোক, রক্তমাংসের মানুষ তো আর সব সময় পাথরের দেব থাকতে পারেন না। সেখানেই গণ্ডগোল। রাজ্যপাল নড়ে বসলে তিনি হয় ‘আমাদের লোক’, নতুবা ‘ওদের’। মুখ খুললে তো কথাই নেই। তাঁর ‘স্বাধীনতা’ বলতে কেন্দ্রের কাছে নিময়মাফিক গোপন রিপোর্ট পাঠানো। সেখানে তিনি তাঁর মতামত জানাতে পারেন। তবে নিন্দুকেরা বলে থাকে, রাজ্যে যদি কেন্দ্রের শাসক দলের বা তার ‘বন্ধু’ দলের সরকার থাকে, সংশ্লিষ্ট রাজ্যপালেরা অনেকে নাকি তখন রুটিন রিপোর্ট পাঠানোর আগে সাতপাঁচ ভাবেন।
দিল্লির ‘কলকাঠি’ অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচিত সরকার ভেঙে রাজ্যপাল ধর্মবীর ‘কলঙ্কিত’ অ্যাখ্যা পেয়েছিলেন। সেটা ছিল এক জন রাজ্যপালের অধিকারের চরমতম প্রয়োগ। তাঁকে নিয়ে ‘আমরা-ওরা’ রাজনীতির মানে বোঝা যায়। কিন্তু পরবর্তী কালে ত্রিভুবন নারায়ণ সিংহ, অনন্তপ্রসাদ শর্মা থেকে হালের গোপালকৃষ্ণ গাঁধী? তাঁরা তো কেউ এখানে সরকার ভাঙতে যাননি। তবু রাজ্যপাল হিসেবে তাঁরা অবিতর্কিত থাকতে পেরেছেন কি?
প্রবীণ গাঁধীবাদী ত্রিভুবন নারায়ণ দিল্লির কংগ্রেস সরকারের হুকুমনামা মেনে রাজস্থান যাওয়ার বদলে ইস্তফা দেন। সে দিনের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এবং তাঁর দল ‘লাল সেলাম’ স্লোগান দিতে দিতে পদত্যাগী রাজ্যপালকে বারাণসীর ট্রেনে তুলতে গিয়েছিলেন। আবার শিক্ষাক্ষেত্রে ‘অনিলায়ন’ প্রক্রিয়াতে প্রথম ঘা মেরে রাজ্যপাল শর্মা বিধিসম্মতভাবে সন্তোষ ভট্টাচার্যকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করার পরে সি পি এমের এমন রোষানলে পড়েন যে, স্বল্প মেয়াদ কাটিয়ে তাঁর চলে যাওয়ার সময় রাজ্যের এক জন মন্ত্রীকেও সৌজন্য রক্ষায় পাঠানো হয়নি। জ্যোতিবাবু বলেছিলেন, “আমি তো জানিই না, উনি চলে যাচ্ছেন!”
নন্দীগ্রাম-কাণ্ড নিয়ে গোপালকৃষ্ণের বিবৃতি কেন্দ্র করে রাজ্য রাজনীতিতে কী ঝড় উঠেছিল, সে সব এখনও টাটকা স্মৃতি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস এবং এই রাজ্যের কংগ্রেস যখন ওই বিবৃতির জন্য রাজ্যপালকে ‘ধন্য ধন্য’ করেছে, এক্তিয়ারের প্রশ্ন তুলে আলিমুদ্দিনের বড়-মেজ-সেজ নেতারা তখন যথেচ্ছ ভাষায় তাঁর ছালচামড়া ছাড়িয়েছেন। একই ভাবে এখন ভাঙড়ের গুন্ডামি বা শিক্ষাক্ষেত্রে সন্ত্রাস ও দলবাজির বিরুদ্ধে বর্তমান রাজ্যপাল মুখ খোলা মাত্র রে-রে করে উঠেছেন তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা। আর রাজ্যপালের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছে সি পি এম এবং কংগ্রেস।
এক্তিয়ার আছে কি নেই, সেই সাংবিধানিক কূটতর্ক অনেক দূর যেতে পারে। কিন্তু কোনও ঘটনায় দেশ-সমাজ-মানবিকতা যদি আলোড়িত হয়, তা হলেও এক জন সুস্থ মাথার সংবেদনশীল মানুষ শুধু রাজ্যপাল হয়েছেন বলে নিশ্চল, নিশ্চুপ বসে থাকবেন? এ কেমন বিচার!
যদি দুঃখ-সুখে বিগতস্পৃহ হয়ে শুধু মিষ্টি হাসা, ফিতে কাটা এবং মাঝেমধ্যে সরকারকে রাজভবনে ডেকে অযাচিত পরামর্শ দেওয়াই রাজ্যপালদের একমাত্র কাজ হয়, কী প্রয়োজন কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাজ্যে রাজ্যে এই ‘সংবিধান রক্ষক’দের রাজখাতিরে পুষে রাখার? কেন তবে বিলোপ করা হবে না রাজ্যপালের পদ? আর কবে আসবে সেই সময়?
মহামহিম বেচারা রাজ্যপালগণ, কাঁটার মুকুট এ বার নামিয়ে রাখুন না!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.