আদালতের রায়ে অনেক সময় অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিবর্তিত হইয়া যায়। সে ক্ষেত্রে পুনর্বিচারের নেপথ্যে থাকে অপরাধীকে আত্মশোধনের সুযোগ দেওয়ার সদিচ্ছা। কিন্তু নির্বাসনের শাস্তি যখন স্রেফ জরিমানায় বদলাইয়া যায়, তখন তাহার পিছনে কীসের ক্রিয়া থাকে? মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাবকে দেওয়া আড়াই বছরের নির্বাসনের শাস্তি যখন অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন রদ করিয়া দেয়, তখন ফেডারেশন সভাপতির কণ্ঠে কিন্তু ক্লাবের ‘এত কালের ঐতিহ্য, ইতিহাস আর জনসমর্থন’-এর অজুহাতই বারংবার উচ্চারিত হইয়াছে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিবে, এমন দীর্ঘ ঐতিহ্যশালী ও জনপ্রিয় বলিয়াই কি ক্লাব কর্তা ও খেলোয়াড়দের দায়িত্ব আরও বেশি ছিল না? তাঁহাদের আচরণে যখন সেই দায়িত্ববোধের কোনও পরিচয় মেলে নাই, তখন শাস্তি মকুব করিয়া কি ভবিষ্যতে ফেডারেশনের কর্তৃত্বকেই আরও নড়বড়ে করিয়া দেওয়া হইল না?
ভবিষ্যতে অন্য কোনও ক্লাব যদি মোহনবাগানের মতো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে, তবে ফেডারেশন কর্তৃপক্ষ কী যুক্তিতে সেই ক্লাবকে শাস্তি দিবেন, যখন একই অপরাধে মোহনবাগানের শাস্তি রদ করিয়া দেওয়া হইল? শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য দুই কোটি টাকা জরিমানা করা হইয়াছে। শূন্য পয়েন্ট লইয়া আই-লিগে খেলা শুরু করিয়া অবনমনের আশঙ্কা ঠেকাইতে হইবে। ভবিষ্যতে আর কখনও খেলা চলাকালীন দল তুলিয়া না-লওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিতে হইবে। কিন্তু এ সবই আড়াই বছরের নির্বাসনের তুলনায় লঘু দণ্ড। গুরু পাপে এই লঘু দণ্ড ক্লাব-কর্তাদেরও উজ্জীবিত করিয়াছে। অনুতাপদগ্ধ হওয়ার পরিবর্তে তাঁহারা রীতিমত আস্ফালন করিয়া বেড়াইতেছেন। ফেডারেশন কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করিয়া শাস্তি মকুবে সফল হওয়ার পরিতৃপ্তি ও অহঙ্কার তাঁহাদের আচরণে প্রকট। এই সমগ্র ঘটনাপরম্পরা দেশের ফুটবল ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক নজির স্থাপন করিয়া দিল। এই সংশয় স্বাভাবিক যে, কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করিতে পারিলে অন্যায় করিয়াও ক্লাব পার পাইয়া যায়। অতঃপর সব ক্লাবই খিড়কি পথে ফেডারেশন কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করার উপায়গুলি জানিতে ব্যগ্র হইবে।
মোহনবাগান ক্লাবের উপর যে শাস্তি হইয়াছিল, তাহা এমনিতেই যথেষ্ট লঘু ছিল। দণ্ড হওয়া উচিত ছিল আরও কঠোর, দণ্ডদাতার হওয়া উচিত ছিল আরও অনমনীয়। পরিবর্তে সহনীয় দণ্ড অবধি যে ভাবে আরও লঘু করিয়া দেওয়া হইল, তাহাতে আশঙ্কা হয়, ভবিষ্যতে ফুটবল ক্রীড়াঙ্গনে উচ্ছৃঙ্খলতা আরও বৃদ্ধিই পাইবে। খেলার মানের বিচারে ভারতীয় ফুটবল এমনিতেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একেবারে নীচের দিকে। বিদেশি খেলোয়াড় ও বিদেশি কোচ ভাড়া করিয়াও সেই মান উন্নয়নের কোনও লক্ষণ এ যাবৎ নজরে পড়ে নাই। উপরন্তু অনিয়ম, যথেচ্ছাচার, কলিকাতা ময়দানের ‘বড় ক্লাব’ হওয়ার সুবাদে টুর্নামেন্ট লইয়া ছেলেখেলা করার এবং পার পাইয়া যাওয়ার ঘটনা আর যাহাই হউক ভারতীয় ফুটবলে কোনও সদর্থক মাত্রা সংযোজন করিবে না। |