পশ্চিমবঙ্গই আগামী কালের ভবিষ্যৎ মুখ্যমন্ত্রী বলিয়াছেন। ইহার উপর আর কথা চলে না। যদি আগামী কাল আসে, তাহার ভবিষ্যৎও আসিবে। সেই ভবিষ্যতের সুপবনে নীল-সাদা নিশান উড়িবে তাহাতে লেখা থাকিবে ‘পশ্চিমবঙ্গ’। অতঃপর, কিছু ছিদ্রান্বেষী ভিন্ন আর কেহ কি তুচ্ছ অতীত অথবা বর্তমান লইয়া ভাবিত হইতে পারে? তবে, আগামিকাল আসিলেও তাহার ‘ভবিষ্যৎ’ ভবিষ্যতেই থাকিবে। কোনও আগামীর বর্তমানেই তাহাকে ছোঁওয়া যাইবে না। অতএব, নিশ্চিন্ত। কিন্তু আজকের বর্তমানে কিছু ছোটখাটো সমস্যা আছে। যেমন, নরেন্দ্র মোদীর ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এর আসরে মুকেশ অম্বানী, অনিল অম্বানী হইতে রতন টাটা বা সাইরাস মিস্ত্রিদের উপস্থিতি চোখ ধাঁধাইয়া দেয়। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বেঙ্গল লিডস’-এ শিল্পপতিদের উপস্থিতি খুঁজিতে হয়। পশ্চিমবঙ্গই যাঁহাদের ব্যবসার কেন্দ্র, তাঁহারা অগত্যা হাজির হইয়াছেন। কিন্তু যাঁহাদের না আসিলেও চলে, তাঁহারা আসেন নাই। এক জনও নহেন। কেন, সেই প্রশ্নের একটি উত্তর মুখ্যমন্ত্রী খুঁজিলে হলদিয়াতেও পাইতেন এবিজি গোষ্ঠীর খালি করিয়া দেওয়া বার্থ-এ। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সম্ভবত সেই উত্তর খুঁজিবার সময় নাই। তিনি গান ভালবাসেন। মঞ্চে গান হইয়াছে। গুজরাতে শিল্প হয়। যিনি যাহাকে যেমন ভাবে কামনা করেন, তেমন ভাবেই পান। মোদী শিল্পপতিদের নিকট বিনিয়োগ কামনা করিয়াছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রসংগীত। কেহই বিফলকাম হন নাই।
বিনিয়োগ টানিতে গুজরাতের সাফল্য যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভাবাইয়াছে, তাহা স্পষ্ট। তিনি বিশদ ব্যাখ্যা করিয়াছেন, কেন গুজরাত আজই পারে আর পশ্চিমবঙ্গ পারে না (কিন্তু, আগামিকালের ভবিষ্যতে...)। সেই ব্যাখ্যায় বহু কথা আছে, কিন্তু দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মূল ফারাকটির কথা মমতাদেবী উল্লেখ করেন নাই। নরেন্দ্র মোদী বিনিয়োগের প্রশ্নে আন্তরিক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নহেন। তাঁহার আন্তরিকতার অভাবের বহু প্রমাণ, স্বভাবোচিত মণিমুক্তার আকারে, তিনি বেঙ্গল লিডস-এর প্রথম দিন হলদিয়ায় ছড়াইয়া দিয়াছেন। পশ্চিমবঙ্গের বাণিজ্যিক মানচিত্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক সংস্থার কর্ণধারকে তিনি চেনেন না। তাঁহারই সংস্থার অন্য এক কর্তাকে তিনি সেই কর্ণধারের নামে ডাকিয়া কথা বলিয়া গেলেন। রাজ্যের কোথায় কোন বড় মাপের শিল্প তৈরি হইতেছে, মুখ্যমন্ত্রীর নিকট সেই খবর নাই। জমির সমস্যায় কোথায় তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প আটকাইয়া আছে, মুখ্যমন্ত্রী তাহাও জানেন না। অজ্ঞানতা বহু ক্ষেত্রেই আশীর্বাদ ঠিকই, কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রে নহে। শিল্প লইয়া যে তাঁহার মাথাব্যথা নাই, আন্তরিকতার এই অভাব তাহা শতকণ্ঠে জানাইয়া দিতেছে। শিল্পপতিরা শুনিতেছেন। শিল্পায়নের উপযুক্ত কিছুই পশ্চিমবঙ্গে নাই। তবুও যদি মুখ্যমন্ত্রী আন্তরিক হইতেন, সত্যই শিল্পায়ন চাহিতেন, হয়তো কেহ এই রাজ্যে বিনিয়োগ করিবার কথা ভাবিয়া দেখিতেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর যাবতীয় আগ্রহ যদি শিল্পপতিদের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনিতেই সীমাবদ্ধ থাকে, তাহা হইলে আর কথা বাড়াইয়া লাভ নাই।
ব্যক্তিগত রুচির উপর প্রশ্ন চলে না। মমতাদেবী যদি নীরস টাকাকড়ির হিসাবের বদলে গানেই শান্তি খুঁজিয়া পান, তবে তাঁহাকে মুখ্যমন্ত্রী করিবার জন্য বাঙালি কপাল চাপড়াইতে পারে, কিন্তু তাঁহাকে দোষ দেওয়া অনুচিত। প্রশ্ন হইল, তিনি ‘যুব উৎসব’ ইত্যাদি লইয়াই যখন সময় কাটাইয়া দিতে পারিতেন, তখন ‘বেঙ্গল লিডস’-এর ঝামেলায় গেলেন কেন? তিনি নানান কাজে ব্যস্ত, হাতে তেমন সময় বাঁচে না। শিল্পপতিদেরও হাতে নষ্ট করিবার মতো প্রচুর সময় রহিয়াছে, এমন ভাবা ভুল। সময়ের এই অপচয় কেন তবে? তাঁহার যে শিল্পপতিদের কিছুই দেওয়ার নাই জমি নহে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্বীকৃতি নহে, রাজনৈতিক কোন্দল হইতে নিরাপত্তা নহে, এমনকী মনোযোগও নহে এই কথাটি তিনি স্পষ্ট বুঝাইয়া দিতে সক্ষম হইয়াছেন। তাঁহার নিকট কাহারও যে কিছু চাহিবারও নাই, এই কথাটি তিনি বুঝিলেই ল্যাঠা চুকিয়া যায়। তাহার পর পশ্চিমবঙ্গে গান হইবে, সুন্দরবনে ‘আফ্রিকান সাফারি’ হইবে। আর আগামিকালের ভবিষ্যতে কী হইবে, মুখ্যমন্ত্রী তো বলিয়াই দিয়াছেন। |