|
|
|
|
ভারত আত্মার উদযাপন ফেসবুক-আইপডে
অগ্নি রায় • ইলাহাবাদ |
কল্কে থেকে কি বোর্ড দু’টিতেই তিনি স্বচ্ছন্দবিহারী!
এই দুইয়ের মধ্যে মেলবন্ধন করাই আজকের যুগে কুম্ভের মূল মন্ত্র হয়ে ওঠা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
নাগা সাম্রাজ্যের একমাত্র শ্বেতাঙ্গ সন্ন্যাসী, মোহন্ত বাবা রামপুরির আশ্রমে বসে রয়েছি। সব চেয়ে বিপজ্জনক বলে কুখ্যাত এই সুবিশাল ‘জুনা দশনামী আখড়া’য় তৈরি হয়েছে শ’য়ে শ’য়ে কুটির। গত দু’দিনের উন্মত্ততার পর আপাতত শান্ত শিবির। বসে রয়েছেন ভস্মাবৃত, নগ্নগাত্র, সিঁদুরচর্চ্চিত ভয়ালদর্শন সাধুরা। ধোঁয়ার ভিতর থেকে তাঁদের দেখতে হয়। অনেকে গেরুয়াধারী, তপোমগ্ন। আছেন খাড়িয়াবাবা। গত তিন বছর নাকি তিনি বসেননি, সাধনা করছেন দাঁড়িয়ে! গিরি, পুরি, অরণ্য, বন, পর্বত ইত্যাদি দশ নামে বিভক্ত জুনা আখড়ায় সাধুদের পোশাক, আচার, সাধনাও দশ রকম।
তার মধ্যে মার্কিন সাধু রামপুরির আশ্রমে পরিবেশ একেবারে আলাদা। ত্রিশূল রয়েছে, অদূরে বাঘছাল পাতা, শিষ্যরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলিমে প্রসাদ পাচ্ছেন। কিন্তু রে ব্যান সান গ্লাসের আড়ালেও ঘোলাটে নয় এই নাগা সন্ন্যাসীর চোখ। কথায় শিথিলতা দূরস্থান, বরং পেশাদারের তৎপরতা। পাশে ব্ল্যাক বেরি-সহ দু’টি মোবাইল। আর এক মার্কিন সন্ন্যাসী সে সব সামলাচ্ছেন। রামপুরি নিজে মাঝেমাঝেই উঠে পিছনের তাঁবুতে রাখা অ্যাপলের আইপডে দেখে আসছেন তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টের সাম্প্রতিক আপডেট। সেরে নিচ্ছেন প্রয়োজনীয় টুইট-ও। |
মোহন্ত রামপুরি। ছবি: কৌশিক ভট্টাচার্য |
“দু’হাজার বছর আগে পাণিনি প্রথম মেটাল্যাংগুয়েজ (কোনও একটি ভাষাকে বোঝার ভাষা) উপহার দিয়েছিলেন সভ্যতাকে। আর দু’হাজার সনে এসে ভারতের আইআইটি পাশ করা যুবশক্তি নতুন এক মেটাল্যাংগুয়েজ দিয়েছে বিশ্বকে। তথ্যপ্রযুক্তিতে ভারতেরই জয়জয়কার। আমরাও কেন তাকে কাজে লাগাব না বলতে পারেন?” রামপুরি ভারতে রয়েছেন প্রায় চার দশক। থাকেন হরিদ্বারে। ইংরেজিতে মার্কিন টান যায়নি। কিন্তু সমান স্বচ্ছন্দ সংস্কৃত ও হিন্দিতেও। “সাইবার প্রযুক্তির মাধ্যমে যে ভোগবাদ-পণ্যবাদের শ্রীবৃদ্ধি ঘটানো হয়, আমি তার পক্ষে নই। কিন্তু এই মাধ্যমগুলি ব্যবহার করে মানুষকে আত্মসচেতন করে তোলা যায়। নিজের বক্তব্য দ্রুত বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া যায়,” জানাচ্ছেন তিনি।
নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে রামপুরির। তাঁর ‘অটোবায়োগ্রাফি অফ আ সাধু’ আমেরিকায় নাকি হটকেক। আশ্রমের জন্য অনুদানের আবেদন জানান ফেসবুকের মাধ্যমে। বিশ্বজোড়া শিষ্যমণ্ডলীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন টুইটারে। এ নিয়ে কোনও রাখঢাক নেই নাগা সন্ন্যাসীদের অন্তঃরাষ্ট্রীয় মণ্ডলের এই মোহন্তের। কুম্ভে প্রথম আসেন ১৯৭১-এ। এই মেলা আজও তাঁর কাছে প্রাসঙ্গিক। তাঁর ব্যাখ্যা, “কুম্ভের মৌলিক ধারণাটি হল সুষ্ঠু ভাবে যজ্ঞ করা। প্রাচীন ভারতে রাজারা যা করতেন প্রজাদের হিতে। সন্ন্যাসীরা যজ্ঞের মাধ্যমে আশীর্বাদ করতেন। প্রকৃতির যা কিছু আহরণ করার মতো, সেগুলি প্রয়োগের কৌশল শেখানো হত। এতে কুসংস্কার বা অলৌকিকত্ব নেই, রয়েছে সুপ্রশিক্ষিত শৃঙ্খলাবদ্ধ এক আচার, সুসংহত জীবন যাপন।”
নাগা সন্ন্যাসীর আখড়া নয়, মনে হচ্ছে বসে রয়েছি সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপকের ক্লাসে, যিনি জানেন আধুনিক ম্যানেজমেন্ট শাস্ত্রের গোড়ার কথা। না হলে কেনই বা বলবেন, “আজ ভারতের বিশ্বজোড়া যে সমৃদ্ধি, দক্ষতা এবং সম্ভাবনা, তাকে উপলব্ধি করার মঞ্চ হল এই মেলা। এখানে লোকে যোগ শিখতে আসে না, ম্যাজিক দেখতেও না। আসে প্রবীণ এবং অভিজ্ঞদের আশীর্বাদ নিতে। ভারতের সুপ্রাচীন সংস্কৃতিকে নিজের ভিতরে উদ্যাপন করতে।” তাঁর কথায়, ভোগবাদে ক্লান্ত পশ্চিম। তাকে ভারতীয় দর্শনের কাছে আনতে তথ্যপ্রযুক্তির বড় ভূমিকা রয়েছে।
ভারত-আত্মার এই উদ্যাপনে বিদেশিদের উপস্থিতি ক্রমেই বাড়ছে মেলায়। সন্ন্যাস নিয়ে আসছেন সবাই, তা-ও নয়। ইউরোপ-আমেরিকা ভেঙে পড়ছে মহা মানবমেলা চাক্ষুষ করতে। পর্যটন, ফোটোগ্রাফি, ছবি আঁকা, গিটারে রামধুন চলছে সব কিছুই। জুনা আখড়ার কাছেই পাওয়া গেল ব্রিটিশ সন্ন্যাসিনী মনোরমাদেবী দাসীকে। পড়ে ফেলেছেন পতঞ্জলির যোগসূত্র, গীতা। হরিদ্বারে গুরুর কাছে গিয়েছেন অন্তত ২০ বার। কিন্তু প্রয়াগ কুম্ভে এই প্রথম। প্রথম আলাপেই হেসে বললেন, “জয় রাধে।” স্পেনে ভারতীয় দর্শনের
ক্র্যাশ কোর্স করান। “ভারতের আত্মাকে আন্তর্জাতিক স্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি নিজের মতো করে। এ বারের অভিজ্ঞতা এক লহমায় সামনে তুলে ধরল গোটা ভারতকে। অনেকটা বিশ্বরূপ দর্শনের দশা হয়েছে আমার,” এক ঘোরের মধ্যে কথা বলছেন মনোরমা।
একই রকম ঘোরে রয়েছেন মার্কিন তরুণ বেঞ্জামিন পার্কার। বান্ধবীকে নিয়ে প্রাক্-মধুচন্দ্রিমা করতে এসেছেন কুম্ভমেলায়! হলিউডি তারকাদের জেরেও যা নজর কেড়েছে পাশ্চাত্যের। মাইকেল ডগলাসকে নিয়ে আসার কথা রয়েছে ক্যাথরিন জিটা জোন্সের। বেঞ্জামিন বললেন, “এ এক আলাদা বিশ্ব। হোটেলে না থেকে আমরা তো তাঁবুতেই রাত কাটাচ্ছি, লঙ্গরের খাবার খাচ্ছি।” গোটা মেলা জুড়ে প্রবল এক ‘পজিটিভ এনার্জি’-র স্রোত। ভাসছেন বেঞ্জামিন ও তাঁর সঙ্গিনী।
মহাকুম্ভে কী আশ্চর্য উদ্যাপন পশ্চিমী প্রাক্-মধুচন্দ্রিমারও! |
|
|
|
|
|