শতায়ু হওয়ার আগেই থামল ছোট রেল
র মাত্র একটা টেস্ট। ৯৯টি টেস্টেই থেমেছে তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ার। ১০০ টেস্ট না খেলার আক্ষেপ আজও যায়নি মহম্মদ আজহারউদ্দিনের। আর মাত্র চারটে বছর। কাটোয়া-আমোদপুর ছোট রেলের যাত্রীদের আক্ষেপটাও ফেলনা নয়। “ইস্স, আর চারটে বছর টানলেই আমাদের এই রেলও হত শতায়ু! ভবিষ্যতে বলতে পারতাম, একশো বছর বয়সের রেলে চড়েছি আমরা।”রবিবার এই হাহুতাশ শোনা গেল ছোট রেলের ‘শেষযাত্রা’য় সামিল অনেকের মুখেই।
৯৬ বছরের যাত্রার আনুষ্ঠানিক ইতি পড়ে গেল এ দিনই। ফুল-মালায় সাজা ট্রেন চলছে দুলকি চালে। দু’পাশে দাঁড়িয়ে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ। স্টেশনে স্টেশনে বিদায় সংবর্ধনা নিয়ে যাত্রা শেষ করল কাটোয়া-আমোদপুর ছোট রেল।
ন্যারো গেজ এই লাইনে ট্রেনের সংখ্যা দু’টি।
কাটোয়া-আমোদপুর লাইনে শেষ বারের মতো চলল ছোট রেল। রবিবার। —নিজস্ব চিত্র
চারটি করে কামরা নিয়ে দিনে এক বারই যাতায়াত। ৫২ কিলোমিটার পথে ১২টি স্টেশন। বীরভূমের আমোদপুর থেকে লাভপুর, কীর্ণাহার হয়ে বর্ধমানের কাটোয়া পর্যন্ত এই লাইন এ বার বড় হবে। রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী জানান, লাইনটি ব্রডগেজ করার কাজ শুরু হয়েছে। তবে, নলহাটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপ-নির্বাচনের বিধি-নিষেধে ওই কাজের আনুষ্ঠানিক সূচনা এখনই হচ্ছে না।
সেই কবে ১৯১৭ সালে ট্রেন চলা শুরু এই লাইনে। লাইন পেতেছিল ব্রিটেনের ‘ম্যাকলিয়ড রাসেল’ সংস্থা। ট্রেন চালাত ‘ম্যাকলিয়ড লাইট’। ১৯৬৬-এর পরে তা ভারতীয় রেলের হাতে আসে। এক সময়ে এই লাইনে আট থেকে দশ কামরার ছ’জোড়া ট্রেন চলত। ৫২ কিলোমিটার পথ পেরোতে লাগত ঘণ্টা দু’য়েক। ১৯৯৮-এ ট্রেনের ছাদ ভেঙে পড়ে। কয়েক বার ট্রেন লাইনচ্যুতও হয়েছে। ২০০৪-এ সর্বোচ্চ গতি বেঁধে দেওয়া হয় ১৫ কিলোমিটারে।
শেষ বারের যাত্রার সাক্ষী হতে এ দিন ট্রেনে সওয়ার বহু মানুষ। বর্ধমানের নিরোল, কান্দরা, বীরভূমের লাভপুরে বাসিন্দারা যাত্রীদের মিষ্টি, চকোলেট দেন। কীর্ণাহারে ট্রেন দাঁড় করিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। ছোট ট্রেনকে বিষয় করে আঁকা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল একটি ক্লাব।
৪৫ বছর ধরে এই ট্রেনে বাদাম থেকে ঘুগনি, নানা জিনিস ফেরি করেছেন মুর্শিদাবাদের সালারের সোনারুন্দি গ্রামের অনিল সাহা। অসুস্থতার কারণে বছর সত্তরের অনিলবাবু এখন আর ফেরি করেন না। রবিবারের যাত্রায় সামিল তিনিও। বললেন, “১৯৭৮-এ বন্যার পরে কাটোয়ার অজয়ের সেতু থেকে কেতুগ্রামের পাচুন্দি পর্যন্ত রেললাইন বলে কিছু ছিল না।
ছোট রেলকে বিদায় জানাতে অনুষ্ঠান কীর্ণাহার রেল
স্টেশনে। ররিবার ছবিটি তুলেছেন সোমনাথ মুস্তাফি।
১১ মাস ট্রেন বন্ধ ছিল। চলার পথে বারবার ধাক্কা খেলেও থমকে যায়নি এই ট্রেন।” আমোদপুরের নঈম শেখ, কোমরপুরের সুজিত মাঝিদের স্মৃতিচারণা, “ট্রেন যখন বাষ্পে চলত, মাঝে মধ্যে জল ফুরিয়ে যেত। আমরা পুকুর থেকে জল এনে দিতাম। ট্রেন লাইনচ্যুত হলে যাত্রীরাই ধরাধরি করে ফের লাইনে তুলত।”
কলকাতা থেকে লাভপুরে বাড়ি ফিরতে সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কাটোয়া থেকে এই ট্রেনই ধরতেন। তাঁর নানা লেখায় ছোট রেলের কথা পাওয়া যায়। তাঁর ভাইপো বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সত্যজিৎ রায় ‘অভিযান’ ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও ওয়াহিদা রহমানকে নিয়ে এই ট্রেনে শু্যটিং করেছেন। তপন সিংহের ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’তেও এই ট্রেনের দৃশ্য রয়েছে।” স্কুল ফাইনাল দিতে কীর্ণাহার থেকে ছোট ট্রেনেই কাটোয়া যেতেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর ছেলে, জঙ্গিপুরের সাংসদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “আমাদের পরিবারের সবারই এই ট্রেনের নানা স্মৃতি রয়েছে। শখেও ওই ট্রেনে চড়েছি বহু বার।”
রয়েছে অন্য অভিজ্ঞতাও। বছরখানেক আগেই পাচুন্দির কাছে কিশোরী মেয়ের মাথায় বন্দুক ধরে ট্রেন থেকে নামিয়ে ধর্ষণ করা হয় এক মহিলাকে। তিনি বললেন, “ছোট রেল নিয়ে যে সুখস্মৃতি ছিল, ওই দিনের পরে তা অন্ধকার হয়ে গিয়েছে!”
আলো-অন্ধকার, দু’রকম স্মৃতি রেখেই থেমে গেল ছোট রেল। মনোহর আইচের মতো শতায়ু হওয়া আর হল না।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.