জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্লাব-খয়রাতি নিয়ে ক্ষুব্ধ যোজনা কমিশন।
মুখ্যমন্ত্রী সরকারের তহবিল থেকে দু’বছরে আড়াই হাজারের উপরে ক্লাবকে মোট ৬০ কোটি টাকা দিয়েছেন। এখানেই শেষ নয়। আগামী পাঁচ বছর ধরে এই তালিকায় আরও ক্লাব জুড়ে খয়রাতি চালিয়ে যাওয়ার কথাও ঘোষণা করেছেন সদ্য গত পরশু। এই খবর জানার পরে
যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া রাজ্য সরকারের কাছ থেকে রিপোর্ট চাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু কেন ক্ষুব্ধ যোজনা কমিশন?
যোজনা কমিশন সূত্রে খবর, বিভিন্ন সূত্রে তারা জানতে পেরেছে, ক্রীড়া ক্ষেত্রের জন্য যে যোজনা বরাদ্দ রয়েছে, তার থেকে ক্লাব-খয়রাতির টাকা জোগাচ্ছে রাজ্য সরকার। যোজনা কমিশনের এক উপদেষ্টা বলেন, “যোজনা বরাদ্দ থেকে এই অর্থ দেওয়া একেবারেই আর্থিক নীতিবিরোধী। এই বরাদ্দ ব্যবহার করা হয় এমন কিছুতে, যাতে স্থায়ী সম্পদ (ডিউরেবল অ্যাসেট) তৈরি করা যায়। যেমন, ক্রীড়া মন্ত্রকের সম্পদ হল স্টেডিয়াম, ফ্লাডলাইট, মাল্টিজিমের মতো পরিকাঠামো।” যোজনা কমিশনের পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কিত রিপোর্টে বলা হচ্ছে, রাজ্যে ৯৩ পয়সা খরচ হয় যোজনা বহির্ভূত ব্যয়ে আর ৭ পয়সায় উন্নয়ন হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর অমিত মিত্র বারবার বলছেন যে, এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে অতীতের বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু যোজনা কমিশনের প্রশ্ন হল, যখন যোজনা বহির্ভূত ব্যয়ের এই পরিস্থিতি, তখন যোজনা বরাদ্দ থেকে কি এই ধরনের খরচ করা উচিত? যোজনা কমিশন কিন্তু মনে করে, যোজনা বরাদ্দও অডিট অনুসারে হওয়া উচিত। অর্থাৎ কোন খাতে কতটা প্রয়োজন, তার একটা আগাম বিশ্লেষণ হওয়া উচিত। অথচ রাজ্য সরকারেরই কোনও কোনও মহলের আশঙ্কা, এই টাকা ক্লাবগুলি কী ভাবে খরচ করবে, তার কোনও অডিট হওয়ার সম্ভব নয়। শুধু মন্টেক নন, যোজনা কমিশনের বহু উপদেষ্টাই তাই মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণায় উদ্বিগ্ন। যে রাজ্যের ২.২ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ, সেই রাজ্যে এই ধরনের তহবিল বরাদ্দ উদ্বেগজনক।
যোজনা কমিশনের রিপোর্টে আরও বলা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে ২০০১ সালে কৃষি থেকে শিল্প অভিমুখে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল। জনগণনার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গে ১৯৯১ সালে কৃষক ছিলেন শতকরা ৩৮.৪ ভাগ। যা ২০০১ সালে কমে দাঁড়ায় ২৫.৪ ভাগে। পাশাপাশি অকৃষিজাত কাজের সঙ্গে ’৯৯ সালে যেখানে যুক্ত ছিলেন ২৯.৩% মানুষ, ২০০১ সালে সেখানে বেড়ে হয় ৪১.৬%। কৃষি ক্ষেত্র থেকে সরে অন্য কর্মক্ষেত্রে চলে যাওয়ার এই ধারাকে যোজনা কমিশন বলছে, অর্থনীতির পক্ষে ইতিবাচক। যোজনা কমিশনের এই তথ্য পেয়েছে কেন্দ্রীয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রকের সমীক্ষা থেকে। যোজনা কমিশন বলছে, যেখানে পশ্চিমবঙ্গ-সহ গোটা বিশ্বে কৃষি ক্ষেত্র থেকে অন্য কর্মক্ষেত্রে চলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কোনও ভাবেই কৃষিজমি বিপন্ন না করার নীতি নিয়েছে। তাই তারা বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করবে না বলে জানিয়েছে। এই শিল্প-বিরোধী নীতির ফলে পশ্চিমবঙ্গে বেকার যুবকদের সংখ্যা বাড়বে বই কমবে না। এই আর্থিক সঙ্কটের ফলে রাজ্য জুড়ে বাড়বে সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাও। যোজনা কমিশনের পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ক উপদেষ্টারা ফি বছর পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করেন। এই রিপোর্ট মূলত রাজ্য সরকারের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই তৈরি হয়। কিন্তু উপদেষ্টারা তাঁদের মতামতও এই রিপোর্টে ব্যক্ত করেন। জ্যোতি বসু থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অশোক মিত্র থেকে অসীম দাশগুপ্ত, যোজনা কমিশন কিন্তু রাজ্য সরকারের বহু অবস্থানের সমালোচনা করেছে। মধু দণ্ডবতে যখন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন, বাম শাসকদের বন্ধু-নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি বেশ কিছু বিষয়ে রাজ্য সরকারের অর্থনীতির সমালোচনা করেছিলেন।
যোজনা কমিশন আজও পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক সমালোচনায় মুখর। যোজনা কমিশন বলছে, ১৯৯৯-২০০০ সালে পশ্চিমবঙ্গে মোট শিল্পের মধ্যে প্রাথমিক ক্ষেত্রে কাজ করতেন ৩৪ ভাগ মানুষ। এটি মূলত কৃষি ক্ষেত্র। ২০০৪-০৫ সালে এসে এই ক্ষেত্রে কর্মরতের সংখ্যা কমে হয়ে যায় ২২ শতাংশ। এই সময়ের মধ্যে সেকেন্ডারি সেক্টর, যা মূলত উৎপাদন শিল্প ক্ষেত্র, সেখানে বড় পরিবর্তন দেখা যায়নি (পাঁচ বছরে ১৮ শতাংশ থেকে তা সামান্য কমে ১৭ শতাংশ হয়েছে)। কিন্তু বেড়েছে টার্শিয়ারি (যা মূলত পরিষেবা ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত) ক্ষেত্রে কর্মরতের সংখ্যা। ৪৮ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৯ শতাংশ। যোজনা কমিশনের বক্তব্য, এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, কৃষির জীবিকা থেকে মানুষ সরে যাচ্ছে। এ কথা মাথায় রেখেই রাজ্য সরকারকে হাঁটকে হবে। ক্ষুব্ধ যোজনা কমিশন আরও বলছে, এই নিয়ে ভাবনাচিন্তা বা নীতি প্রণয়ন না করে ক্লাবকে খয়রাতি করে চলাটা এক ধরনের ‘রাজনৈতিক ভর্তুকি’। যোজনা কমিশনের এক কর্তা আজ বলেন, “পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এতে রাজনৈতিক ডোপিং হতে পারে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির কোনও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হতে পারে না।”
আগামিকাল হলদিয়া শিল্প সম্মেলন ‘বেঙ্গল লিডস’ শুরু হচ্ছে। তার আগে যোজনা কমিশন কিন্তু এমন একটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, যা নিয়ে শিল্পমহল বারবার সরব হয়েছে। তা হল বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ। ক্ষমতায় আসার পরে
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিষ্কার জানিয়ে দেন, তাঁর সরকার এ জন্য জমি নেবে না। শিল্প সংস্থাকে জমি মালিকদের কাছ থেকে কিনে নিতে হবে।
যোজনা কমিশন জানাচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে নতুন শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে জমি-সঙ্কট এখন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
পশ্চিমবঙ্গে ৩৭ হাজার ৫৭৪ হেক্টর অকৃষি জমি রয়েছে। এর মধ্যে ৬ হাজার হেক্টর জমি রাণীগঞ্জ-আসানসোলে কয়লাখনি। সাড়ে ৮ হাজার পাবর্র্ত্য এলাকায়। ৪ হাজার ৭০০ হেক্টর তরাই-তিস্তা এলাকায় বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে। এ সব এবং আরও কিছু ক্ষেত্র বাদ দিলে শিল্পযোগ্য
অকৃষি জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৭১ হেক্টর। ২০০৭ সালের হিসেব ছিল, প্রস্তাবিত শিল্পের জন্য প্রয়োজন ৩৬ হাজার ৪২৭ হেক্টর, যা ২০১৩ সালে এসে আরও বেড়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, তখনই যা শিল্পযোগ্য অকৃষি জমি রয়েছে, তাতে চাহিদা মিটবে না। কৃষি জমি অধিগ্রহণ করতেই হবে।
২০০৭ সালে বণিকসভা সিআইআই বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষাকারী সংস্থা কেপিএমজি-র সঙ্গে যৌথ ভাবে একটি সমীক্ষা করে। তাতে দেখা যায়, শতকরা ৫৭ ভাগ মানুষ মনে করেন, শিল্পের জন্য কৃষিজমি নেওয়া প্রয়োজন। আর ৮৬ শতাংশ মানুষ মনে করেন, কৃষিজমি নিলে খাদ্যসুরক্ষার উপর তার কুপ্রভাব পড়বে না। যোজনা কমিশন বলছে, রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখন জমি নিয়ে শিল্প করতে রাজি, তখন সেই পথে না হেঁটে রাজ্য সরকার ক্লাবগুলিতে ‘হরির লুট’ করছে
কেন? এর ফলে শিল্পায়ন তো সম্ভবই নয়, উল্টে রাজ্যে অসামাজিক কার্যকলাপ বাড়ার আশঙ্কা যথেষ্টই। বিষয়টি নিয়ে যোজনা কমিশনের পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত অফিসাররা রাজ্যের যোজনা পর্ষদের সঙ্গে শীঘ্রই আলোচনায় বসবেন। |