|
|
|
|
হাজার তাঁবুতে সঙ্গম যেন মহাভারত-নগরী |
মনের মহাকুম্ভে আজ প্রথম শাহিস্নান |
অগ্নি রায় • ইলাহাবাদ (প্রয়াগ) |
মেলা তো মনেরই। বিশ্বাসীর কুম্ভে অমৃত জাগছে শোক-তাপ, পাপ-জরা, কামনা-বাসনার ঢেউ সরিয়ে! অবিশ্বাসীর কুম্ভে মেলা মানুষের, আয়োজন ও অর্থের, অভিজ্ঞতা ও ইতিহাসের। আর এই সব কিছু মিলেই মনের মেলা মহাকুম্ভ। ডুব দিতে হবে সেই হৃদি কুম্ভ সায়রে!
বাঘের কামড়ের মত শীতকে তুড়ি মেরে, পদপিষ্ট হওয়ার ভয়কে অগ্রাহ্য করে, শৈব আর বৈষ্ণবদের সম্ভাব্য সংঘাতকে পাত্তা না দিয়েই ডুব দিতে হবে কাল। উত্তেজনায় তাই আজ ঘুম নেই প্রয়াগের।
মন নদীর কূলে এই সৈকতভূমি। রোজই যেখানে মহাকালের পলি পড়ছে। পড়ুক। সেই পলি সর্বাঙ্গে মেখে মহাকুম্ভ প্রস্তুত আগামিকাল মকর সংক্রান্তির পুণ্যযোগে প্রথম শাহিস্নানের জন্য। গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর ত্রিবেণীতে ভোরের আলো ফোটারও ঢের আগে ব্রাহ্ম মুহূর্তে ডুব দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি লক্ষ লক্ষ মানুষের। দেবতা-অসুরের তুলকালাম যুদ্ধে অমৃতের কলস থেকে বারো ফোঁটা গড়িয়ে পড়েছিল প্রয়াগ, নাসিক, হরিদ্বার ও উজ্জ্বয়িনীতে। সেই কবে দক্ষিণের সাধু আদি শঙ্করাচার্য প্রবর্তন করেছিলেন এই মেলার, তার পর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারো বছর অন্তর এই প্রত্যেকটি জায়গায় এক বার করে বসে মহাকুম্ভ। শাস্ত্র ও বিশ্বাস বলে, এখানে স্নান করলে মুছে যাবে এ জন্মের যত পাপ, সরে যাবে জরা, পিছিয়ে যাবে বিনাশ।
ওই তো রসকলি এঁকে খঞ্জনি বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে চলেছেন দীনবন্ধু দাস। তাঁর পিছনে শেষ সূর্য রক্ত ঢালছে ত্রিবেণী সঙ্গমে। কাগজের নৌকায় ভেসে যাচ্ছে গাঁদা ফুল, তেলের প্রদীপ কোনও এক বিষণ্ণ বৈরাগ্যের দিকে। ‘রাধারমন হরি, গোপাল জয় জয়..’ ভারি মিষ্টি কণ্ঠ দীনবন্ধুর। দু’সপ্তাহ হল নদিয়া থেকে এসে এখানে আস্তানা গেড়েছেন। “আস্তানা বলতে হনুমান মন্দিরের পাশে চট, পলিথিন আর বিচালি দিয়ে একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছি। বড় বড় মোহন্তদের বড় আখড়া। আমাদের মতো গরিবদের জন্য বিশেষ সুবিধা নেই”, বলছেন বটে দীনবন্ধু, কিন্তু গলায় আক্ষেপ নেই কোনও। বরং ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে (দশাশ্বমেধ ঘাটে অশ্বমেধের পর প্রজাপতি ঋষি ব্রহ্মাণ্ড তৈরি করেন, যার কেন্দ্রবিন্দু হল এই প্রয়াগ) দাঁড়িয়ে না জানি কোন গূঢ় আনন্দে মশগুল তাঁর মন। |
|
মেলা তো মনেরই। চিনের পর্যটক হিউ এন সাঙ এই মেলা দেখেই তো অভিভূত হয়ে বলেছিলেন, কুম্ভের উৎস রয়ে গিয়েছে মানুষের মনে। সেই কবে দশরথপুত্র তাঁর স্ত্রী এবং ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ভয়াবহ বনজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ কেটে যেতে যেতে দেখতে পেয়েছিলেন আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী (ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমের), আজ সেই পথের দু’ধারে বহুজাতিকের পণ্যবিপণী। এক সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে দেনার দায়ে বিকিয়ে গিয়েছিল এ নগরী। সেই ইলাহাবাদ ঘুরে দাঁড়িয়েছে মহাকুম্ভের হাত ধরে। কেন্দ্রীয় যোজনার মোটা বরাদ্দ এসেছে কয়েক মাস আগে এবং তার সুবাদে শহর থেকে মেলা সৈকতের দিকে যাওয়ার রাস্তা ঝকঝক করছে। এগোতে-এগোতে হঠাৎ করেই নেমে গিয়েছে রাস্তাটা। সেখানে যোজন যোজন জুড়ে বালুর উপর যেন মহাভারতের যুগ ফিরে এসেছে। রাতারাতি নদীর ধারে তাঁবুর এক পূর্ণাঙ্গ শহরই বানিয়ে ফেলেছে প্রশাসন। রয়েছে অস্থায়ী আদালত থেকে প্রচুর পুলিশ চৌকি, দমকল থেকে হাসপাতাল। অদূরেই অভিভাবকের মত দাঁড়িয়ে বাদশা আকবরের বানানো কেল্লা, যার মাথায় এ বার কন্ট্রোল রুম। লক্ষ্য জিপিএস প্রযুক্তিতে এই বিশাল যজ্ঞ নখদর্পণে রাখা। যার জন্য ছড়িয়ে রয়েছে ১৩০টি ক্লোজ সার্কিট টিভি। জায়গায় জায়গায় এলইডি স্ক্রিনে চলছে অবিরল দৃশ্যকাব্য।
“চারটি মহাকুম্ভ দেখেছি। বহু রক্তাক্ত মেলার সাক্ষী। কিন্তু এ বারের মত কড়া নিরাপত্তা আর নজরদারি আগে কখনও দেখিনি,” জানাচ্ছেন শ্রীবাস্তব। উত্তরপ্রদেশের সড়ক পরিবহণ দফতরের প্রাক্তন কর্মী, পক্ককেশ এই ইলাহাবাদির কাছে কুম্ভের চেয়ে বড় নেশা আর নেই। বিশ্বের মেগাতম এই ধর্মমেলা নিঃসন্দেহে দাঙ্গা আর অনুন্নয়নে পীড়িত এই রাজ্যের সব চেয়ে বড় ব্র্যান্ড। যাকে কেন্দ্র করে আক্ষরিক অর্থেই এক ঘাটে স্নান করছে কৃষ্ণনগর থেকে কুমারিকা, বেলজিয়াম থেকে অস্ট্রিয়া। একই বালুতটে কাপড় বদলাচ্ছেন কোটিপতি ব্যবসায়ী থেকে ও নিঃস্ব ভিক্ষুক। এ কি নিছকই অন্ধ ধর্মবিশ্বাস, নাকি নিজের ভিতরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভারত-আত্মাকে খুঁজে পাওয়ার এক শিকড় টানা ডাক? যে ডাকে সাড়া দিতে এসে মানুষের কুম্ভে ডুব দিয়ে গিয়েছেন কত নাস্তিকও। এটাই হয়তো কুম্ভমেলার জাদুকাঠি, যা দেখে সেই ১২৭ বছর আগেই মুগ্ধ হন মার্ক টোয়েন।
তরুণ মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না ঈশ্বরের এই রাজ্যপাটে সুশাসন বজায় রাখার। অনিয়ম, দুর্নীতি আর ত্রুটির অভিযোগ যে উঠছে না তা নয়, কিন্তু তারই মধ্যে চব্বিশ ঘণ্টা লড়ে যাচ্ছেন প্রায় তিরিশ হাজার কর্মী ও পঁচিশ হাজার পুলিশ। দু’লক্ষ হেক্টরের সুবিশাল এই দেবভূমিকে সামলে রাখার সুবিধার্থে ভাগ করা হয়েছে ১৪টি সেক্টরে। কল্পবাসীদের জন্য খাড়া করা হয়েছে ৭ লক্ষ তাঁবু। আনুমানিক প্রায় এক লক্ষ বিদেশি অতিথির জন্য খোলা হয়েছে ফরেন রেসিডেন্ট রেজিস্ট্রেশন অফিস।
এহ বাহ্য। একটি মেলা যে কী ভাবে জাগিয়ে দিতে পারে একটি রাজ্যকে, তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না। অ্যাসোচেমের সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, মহাকুম্ভ প্রায় বারো হাজার কোটি টাকার ব্যবসার সুযোগ এনে দিয়েছে এখানে। কর্মসংস্থান করেছে সাড়ে ছ’লাখ মানুষের। মেলা সৈকতের বাইরে শহরেও ঘরের জন্য কী হাহাকার, টিকিট মিলছে না ট্রেন-বিমানের। পর্যটন সংস্থাগুলির রমরমা।
এই সবের মধ্যে চলছে প্রতিটি সাধুগ্রামের (আখড়া) দিকে দর্পিত শোভাযাত্রা। রৌপ্যখচিত রথে, হাতির পিঠের উচ্চাসনে বসে রয়েছেন বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা প্রধান সন্ন্যাসী (মহামণ্ডলেশ্বর), ডান হাতে বরাভয় মুদ্রা। ধুন্ধুুমার ব্যান্ডে আগে-পিছে চলছে মাইকের নাদ ধর্মে মেশাচ্ছে দেশাত্মবোধও! নয়তো ‘কালী কালী মহাকালীর’ সঙ্গে ‘জারা ইয়াদ করো কুরবানি’-ও জায়গা করে নেয় কী করে! দু’পাশে সার দিয়ে দাঁড়ানো শত শত ভক্ত। পুণ্যের হাতবদল হচ্ছে মুহুর্মুহু, উঁচু আসন থেকে ছুঁড়ে দেওয়া বাতাসা বা চকলেটের টুকরোর জন্য যেন স্বর্ণসন্ধানে ঝাঁপাচ্ছে ভক্তের দল। মূল আখড়া মোট ১৩টি (দিগম্বর, নির্মোহী, নিরঞ্জনী ইত্যাদি), এখানে সেগুলির শাখা-আখড়াও রয়েছে বহু। প্রতিটিই কলকাতার পুজো মণ্ডপের মতো আলো-ঝলমল।
সঙ্গমতীরে রাতের কুম্ভ যেন একটুকরো পুরাণ। আগামিকালের পবিত্র স্নান সেরে অনশ্বরতার দিকে পা বাড়ানোর স্বপ্নে মশগুল।
|
প্রয়াগে পুণ্যস্নান |
• ১৪ জানুয়ারি - মকর সংক্রান্তি
• ২৭ জানুয়ারি - পৌষ পূর্ণিমা
• ৬ ফেব্রুয়ারি - একাদশী
• ১০ ফেব্রুয়ারি - মৌনী অমাবস্যা
• ১৫ ফেব্রুয়ারি - বসন্ত পঞ্চমী
• ২৫ ফেব্রুয়ারি - মাঘী পূর্ণিমা
• ১০ মার্চ - মহাসাবিত্রী
|
|
ছবি: এপি, এএফপি |
|
|
|
|
|