হতে পারত ছ’টি হাসপাতাল। হতে পারত একটা বড় মাপের শিল্প প্রকল্প। কিন্তু এ সব কিছুই হচ্ছে না। রাজ্যের ক্লাবগুলির মধ্যে বিলিয়ে সেই টাকা খরচ করতে চলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
ক্ষমতায় আসার পরেই গত বছর থেকে ক্লাবগুলিকে ২ লক্ষ টাকা করে অনুদান দেওয়ার প্রকল্প চালু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার তিনি ঘোষণা করেছেন, পাঁচ বছর ধরে ক্লাবগুলিকে টাকা দেবে তাঁর সরকার। প্রথম বছর ২ লক্ষ টাকা। পরের চার বছর ১ লক্ষ করে। গত বছর ৭৮১টি ক্লাবকে অনুদান দেওয়া হয়েছিল। এ বার অনুদান পেয়েছে আরও ১৭৫০টি ক্লাব। এই খাতে প্রথম দু’বছরে সব মিলিয়ে খরচ ৬০ কোটি টাকা।
ক্লাবের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়বে বলে জানিয়ে দিয়েছেন ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র। মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছার প্রতিধ্বনি করে তিনি বলেছেন, “প্রতি বছরই আমরা নতুন নতুন ক্লাবকে অনুদানের আওতায় নিয়ে আসব। রাজ্যের প্রতিটি ব্লকে ক্রীড়া-পরিকাঠামো গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য।”
সেই লক্ষ্য মানলে রাজ্যের ৩৪১টি ব্লক (গ্রাম পঞ্চায়েত ৩৩৫১টি), ১১৭টি মিউনিসিপ্যালিটি, ১৩টি নোটিফায়েড এবং কলকাতা-সহ পাঁচটি কর্পোরেশন এলাকার ক্লাবগুলির অনুদান পাওয়ার কথা। ক্রীড়া দফতরে এক কর্তার হিসেব, রাজ্যে শুধু রেজিস্ট্রিকৃত ক্লাবই রয়েছে ৩০ হাজার। এর মধ্যে একটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ন্যূনতম দু’টি ক্লাবকে অনুদান দিলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৬৭০০-র বেশি। এর সঙ্গে শহর এলাকার কমপক্ষে ৩৫০০ ক্লাব যোগ করলে সংখ্যাটা ১০ হাজার হবে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা মতো, পাঁচ বছরে একটি ক্লাবের অনুদান পাওয়ার কথা ৬ লক্ষ টাকা। সেই হিসেবে ১০ হাজার ক্লাবের জন্য সরকারের খরচ হবে ৬০০ কোটি টাকা।
এই টাকায় অনায়াসে একটি বড় মাপের শিল্প প্রকল্প তৈরি হতে পারে বলে শিল্পমহলের অভিমত। শিল্প দফতর সূত্রের খবর, রাজ্যে টাটা হিতাচি কনস্ট্রাকশন সংস্থা লগ্নি করছে ৬৬০ কোটি টাকা, (কর্মসংস্থান ৭০০ জনের), ট্রাক্টর্স ইন্ডিয়ার লগ্নির পরিমাণ ৬০০ কোটি, (কর্মসংস্থান ২০০০ জনের)। দু’টি সংস্থাই নির্মাণ ও পরিকাঠামো শিল্পে ব্যবহৃত ভারী গাড়ি তৈরির প্রকল্প করছে। রিলায়্যান্স সিমেন্ট ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে যে প্রকল্প করবে, সেখানে চাকরি পাবেন ৪০০ জন। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কগনিজ্যান্ট সংস্থা ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ৮০০০ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছে। টিসিএস প্রকল্পে কাজ পাবেন ১৬ হাজার। লগ্নির পরিমাণ
১০০০ কোটি টাকা।
একই ভাবে, একটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল তৈরি করতে ১০০ কোটি টাকা খরচ ধরা হয় বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা। সেই হিসেবে ক্লাবগুলিকে দেওয়া টাকায় ৬টি বড় হাসপাতাল হতে পারত।
পরিকাঠামো খাতে খরচ না-করে রাজ্য সরকার যে ভাবে ক্লাবগুলিকে টাকা বিলোচ্ছে, তার কঠোর সমালোচনা করেছেন অর্থনীতিবিদরা। কলকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক অনুপ সিংহের কথায়, “উৎপাদন বাড়বে, কর্মসংস্থান হবে এমন ক্ষেত্রেই টাকা খরচ হওয়া উচিত। এতে রাজ্যের আয় বাড়বে। ক্লাবকে অনুদান দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন হবে না।” অনুপবাবুর মতে, “রাজ্যের বর্তমান আর্থিক অবস্থার কারণে উন্নয়ন হচ্ছে না। যুবসমাজে অসন্তোষ বাড়ছে। সেই অসন্তোষ কমাতেই ক্লাবকে টাকা দিয়ে বকলমে ‘বেকার ভাতা’ দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী।” সরকার কী কারণে টাকা দিচ্ছে তা পরিষ্কার নয়, মন্তব্য করে অনুপবাবু বলেন, “সরকার
অনুদান দিলে তার খরচেরও একটা নির্দিষ্ট নির্দেশিকা এবং নজরদারি থাকে। এখানে পাঁচ বছর অন্তর একটা নজরদারির কথা বলা হয়েছে বটে, কিন্তু টাকা কীসে খরচ হবে, তা নির্দিষ্ট করা নেই।”
সরকারি দায়িত্বে থাকায় এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক অভিরূপ সরকার। তবে অর্থনীতিবিদ দীপঙ্কর দাশগুপ্ত বলেছেন, “রাজকোষের বর্তমান অবস্থার নিরিখে এ ধরনের খরচ না-করাই ভাল। এমন ক্ষেত্রে টাকা খরচ করা উচিত যাতে সরকারের আয় বাড়বে।” তাঁর মতে, “রাজ্যের এখন পরিকাঠামো উন্নয়নের দিকেই নজর দেওয়া উচিত। না হলে বড় শিল্প দূরঅস্ৎ, ছোট শিল্পও আসবে না।”
ক্ষুব্ধ বিরোধীরাও। বামেরা তো বটেই, কংগ্রেস নেতৃত্বও মমতা-সরকারের সমালোচনা করেছে। পঞ্চায়েত ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রী পেশির জোর বাড়াতেই এ ভাবে দানছত্র খুলছেন বলেই বিরোধীদের অভিমত।
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রশ্ন, “মুখ্যমন্ত্রী নিজে বলছেন রাজ্য চালানোর টাকা নেই। তা হলে এই ভাবে অর্থ বিতরণের যুক্তি কী?” পাশাপাশি তাঁর অভিযোগ, এ ভাবে টাকা দেওয়ার মধ্যে অস্বচ্ছতা এ দুর্নীতির রাস্তাও খোলা হচ্ছে। কারণ, তৃণমূলের সাংসদ ও বিধায়করাই ক্লাব ঠিক করে দিচ্ছেন। সূর্যবাবুর কথায়, “যে মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী টাকা বিলি করেছেন, সেখান থেকে তিনিই বলেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে কুৎসার জবাব দিতে হবে ক্লাবগুলিকে। মানে, পঞ্চায়েত ভোটের আগে উনি পেশির জোর বাড়াচ্ছেন।”
কংগ্রেস নেত্রী তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীপা দাশমুন্সিও বলেন, “ক্লাবগুলিকে অনুদান দেওয়াটা পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি। পঞ্চায়েত ভোটের লক্ষ্যেই এ কাজ করা হয়েছে। সিপিএমের আমলেও ভোটের আগে বেকারদের ঋণ দিয়ে, প্যারাটিচারদের চাকরি দিয়ে রাজনীতি করা হতো। পরিবর্তনের পরেও তার বদল হয়নি।”
তৃণমূল নেতারা অবশ্য দাবি করেছেন, এর আগেও রাজ্য সরকার বিভিন্ন ক্লাবকে অর্থ দিয়েছে। এটা নতুন নয়।
টাকা নিয়ে কী করছে ক্লাবগুলি? কেউ ক্লাবঘর দোতলা করে বিয়ে বাড়ি ভাড়া দিচ্ছে, কেউ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য টাকা তুলে রাখছে, কেউ স্থায়ী পুজো মন্ডপ তৈরি করছে। অনুদানের টাকা পেতে কোথাও কোথাও রাতারাতি প্যাড ছাপিয়ে ক্লাব তৈরি হয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ। আর তাদের টাকা জোগাতে গিয়ে ক্রীড়া দফতরের গুরুত্বপূর্ণ কাজে কোপ পড়েছে। মেয়েদের খেলাধুলার প্রসারের জন্য বাজেটে বরাদ্দ ৪ কোটি টাকা, স্টেডিয়াম ও খেলার মাঠ সংস্কারের জন্য বরাদ্দ ১০ কোটি টাকা চলে যাচ্ছে ক্লাব-খয়রাতি খাতে। তাতেও অবশ্য কুলোচ্ছে না এ বছর। ফলে আরও ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হয়েছে অর্থ দফতরকে। আর্থিক সঙ্কটের গাওনা শিকেয় তুলে রেখেই!
|