ছায়াঘেরা গ্রামের এক বটগাছের কোটরে বাবা-মা’র আদরে বেড়ে উঠেছে একটি কাঠবেড়ালি ছানা। বাবা ওকে বলে, ‘জানিস কাঠু, সীতাদেবী উদ্ধারের পিছনে আমাদের পূর্বপুরুষের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল।’
—কী ভূমিকা বাবা? কাঠু প্রশ্ন করে।
—রামচন্দ্রের সেতুবন্ধনে নুড়ি-পাথর বহন করে রামচন্দ্রকে সাহায্য করেছিল।
বাবার মুখে পূর্বপুরুষের বীরত্বের কাহিনি শোনার পর কাঠু ভাবল তাকেও কিছু করতে হবে। শুধু পুটুসপাটুস লেজ উঁচিয়ে ঘুরে-বেড়িয়ে আর খেয়ে-ঘুমিয়ে থাকার নাম জীবন নয়। বর্ষার আগে বাবা আর মা খাদ্য সঞ্চয়ে ব্যস্ত; সেই সুযোগে কাঠু এ-পাড়া সে-পাড়া বেড়াতে লাগল। হঠাৎ ওর চোখ গেল এক গৃহস্থের উঠোনের উপর আমগাছের এক ডালে। সেখানে সবুজ একটা টিয়াপাখি খাঁচার মধ্যে বসে ঝিমোচ্ছিল। টিয়াকে লক্ষ করে কাঠু বলল, ‘ওহে টিয়ারানি, খাঁচার ভেতরে বেশ তো আছ!’
—কী যে বলো ভাই কাঠু, বন্দিদশা কারও ভাল লাগে? টিয়া বলল।
—কেন, খাবার সংগ্রহের চিন্তা নেই, বাসা তৈরির হ্যাপা নেই; তোমার তো আনন্দে দিন কাটবার কথা!
—দেখো ভাই, দূর থেকে দেখে আমাকে সুখী মনে হতে পারে, কিন্তু এখানে আমি মৃতপ্রায়। সেই কবে নিজের আত্মীয়-পরিজন থেকে আলাদা। খোলা প্রকৃতির কোলে ডানা মেলে ওড়ার স্বাদটাই আলাদা। টিয়া কাঁদতে লাগল।
—কেঁদো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
—কী করে হবে?
—তোমার দেশের বাড়ি কোথায়? কাঠু জিজ্ঞেস করল।
—চূর্ণি নদীর ধারে তিনটে মন্দির আছে; তার মধ্যে সবচেয়ে উঁচু চূড়াটায় অনেকগুলো কোটর আছে। সেই কোটরের মধ্যে আমাদের আত্মীয়-স্বজনেরা বাস করে।
—তা তুমি এখানে এলে কী করে?
—এক ব্যাধ কঞ্চির ডগায় আঠা মাখিয়ে আমাকে ধরেছিল। তার পর আমার ঠাঁই হল এ বাড়িতে।
—আমি তোমার বাড়িতে খবর দেব?
—তুমি তো খুব ছোট, তুমি কি পারবে সেখানে যেতে? টিয়ার গলায় উৎকণ্ঠা।
—আমার পূর্বপুরুষেরা খুব সাহসী। আমরাও। কাঠু তখন রামচন্দ্রের সেতুবন্ধনের প্রসঙ্গ তুলে ধরল।
—তবুও পদে পদে বিপদের আশঙ্কা। নিজের দিকে খেয়াল রেখো।
—বিদায় টিয়ারানি; তুমিও ভাল থেকো।
পর দিন খুব সকালে কাঠবেড়ালি কোটর থেকে বেরিয়ে এল। সবে সূর্য উঠছে; পাখপাখালির কূজনে মুখর হয়ে উঠল প্রকৃতি। কাঠু এ গাছ সে গাছ নাচতে নাচতে পিচ রাস্তায় নেমে এল। একটা শালিক পাখি খাবার খুঁজতে ব্যস্ত; কাঠু তাকে বলল
শালিক পাখি শালিক পাখি বলতে পারো ভাই
চূর্ণি নদীর ধারে যাব রাস্তা জানা নাই। |
শালিক জানাল, সূর্য বরাবর পাকা রাস্তা ধরে গেলে একটা ব্রিজ পড়বে। ওই ব্রিজের নীচে দিয়ে চূর্ণি নদী বয়ে চলেছে। কাঠু নির্ভীক চিত্তে এগিয়ে গেল। আকাশে তখন লাল সূর্য মিটিমিটি হাসছে টলটলে নদী জল ছলাৎ ছলাৎ বয়ে চলেছে। দু’একটা জেলে নৌকা মাছ ধরতে ব্যস্ত।
কিন্তু এ বার কোন দিকে যাব, পুবে না পশ্চিমে; কোথায় দেখা পাওয়া যাবে তিন মন্দিরের চুড়ো? এ রকম যখন ভাবছে, তখন একটা পানকৌড়ির দেখা পেল সে। জিজ্ঞেস করল
পানকৌড়ি পানকৌড়ি বলে দেবে আমায়
তিন মন্দির চুড়ো কোথা গেলে পাই?
পানকৌড়ি প্রথমে কাঠুকে পাত্তা দেয়নি; কিন্তু টিয়াপাখির ব্যাথাভরা কাহিনি শোনার পরে ওর হৃদয় বিগলিত হল এবং বলল
কাঠবেড়ালি বন্ধু তুমি ওঠো আমার কাঁধে
তিনটি চূড়ার মন্দিরেতে যাবে খানিক বাদে।
কাঠুকে পিঠে চাপিয়ে পানকৌড়ি অনেক কষ্টে মন্দিরের কাছে পৌঁছে দিল। কাঠু তো দেখে অবাক, সবচেয়ে উঁচু মন্দিরের চুড়োতে অসংখ্য গর্ত। আর গর্তের ভেতরে টিয়াপাখির বাসা। সে চুড়োতে উঠতে লাগল দেখে সর্দার গোছের একটি টিয়া চোখ লাল করে জিজ্ঞেস করল
দেখিনি তো ভাই তোমায় হেথায় কোথা থেকে তুমি এলে
দেবথানে ঠাঁই পাবে না গো হায় এক্ষুনি যাও চলে।
কাঠু সব কথা খুলে বলল টিয়া দলপতিকে; তখন টিয়ার দল সভা ডাকল; ঠিক হল আজ নয়, কাল খুব সকাল সকাল বেরিয়ে পড়া যাবে। রাতে কাঠুকে ভীষণ আপ্যায়ন করল ওরা, খেতে দিল ধান আর ছোলা; থাকতে দিল নিজেদের বাসায়।
পর দিন সকালে প্রায় পঞ্চাশটা টিয়াপাখির একটা দল উড়ে চলল কাঠুদের গ্রামে। এ বারে কাঠু নদীর পাড় ধরে দৌড়ে দৌড়ে চলল; ওকে অনুসরণ করল টিয়ার দল। কাঠুদের গ্রামে যখন পৌঁছল, তখন সূর্য মধ্য গগনে। টিয়ারানি সবেমাত্র খাঁচায় বসে দানা খেতে শুরু করেছে। অমনি সকলে শুরু করল তারস্বরে চিৎকার। বন্দি টিয়ারানির চোখ ফেটে এল জল; এত দিনে সঙ্গীসাথিদের দেখা পেল। এ বার বোধ হয় বন্দিদশা থেকে মুক্তি ঘটবে। টিয়া-সর্দার এগিয়ে এসে ঠোঁট দিয়ে খাঁচার আগল দিল খুলে। গৃহস্থ তখন হাঁ করে দেখছে টিয়া বাহিনীর কাজকর্ম; এতগুলো টিয়াপাখি দেখে বেচারি এগোনোর সাহস পেল না।
কৃতজ্ঞতা জানাতে টিয়া বাহিনী এল কাঠুর বাবা-মার কাছে, ‘অসাধারণ ছেলে আপনাদের; ওর জন্যেই খুঁজে পেলাম আমাদের মেয়েকে। এই কাজের পুরস্কারস্বরূপ কিছু বুনোফুল আর কাঠবাদাম দিয়ে গেলাম।’ বলল টিয়া বাহিনীর সর্দার। টিয়ারানি তখন খুশিতে ডগমগ হয়ে খোলা আকাশে ডিগবাজি খেল; তার পরে কাঠুকে বলল
গল্প হলেও মিথ্যে তো নয় রামায়ণের রটনা
সাহস দিয়ে করলে নতুন মহাকাব্য রচনা।
বিদায়বেলা টিয়ার লাল চঞ্চু কাঠুর ঠোঁট স্পর্শ করল।
|