একটু ধার করেই না-হয় বলি কথাটা, স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষ জয়ন্তী পালনে নিজে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়ে “বোনেরা ভাইরা, আমার বুক আজ আনন্দে ভরে যাচ্ছে!” শিকাগোর বিশ্বধর্ম মহাসম্মিলনের সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতারও (১১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩) একশো কুড়ি বছর পূর্ণ হবে এই বছরেই। একটা কথা মনে রাখা দরকার। স্বামী বিবেকানন্দ ওই বহুখ্যাত পঙ্ক্তিগুলি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে শিকাগোর সমস্ত শ্রোতা যে অমন উচ্ছ্বসিত করতালি দিয়ে উঠেছিলেন সে দিন, তার কারণ ওই সম্মিলনের মূল আদর্শটিকে তিনিই যথার্থ ভাবে অনুভব ও প্রকাশ করতে পেরেছিলেন আর সে আদর্শ ছিল এমন এক বস্তু যা আজও, এই একশো কুড়ি বছর পরও, ঠিক একই রকম প্রাসঙ্গিক। সে দিনের ‘পার্লামেন্ট অব ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়নস্’ সংগঠন করার উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন বিশ্বাস ও বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে এক মঞ্চে এনে সাধারণ মানবতার মানদণ্ড নির্মাণের লক্ষ্যে কিছু অর্থপূর্ণ আলাপ আলোচনার সুযোগ করে দেওয়া। বিবেকানন্দের নিজের জীবনের প্রধান মূল্যবোধও ছিল ঠিক এই আদর্শই। শিকাগোতে তাই তিনি ‘সহনশীলতার’ প্রয়োজন বুঝিয়ে বলেছিলেন। গোষ্ঠীতন্ত্র, অসহিষ্ণুতা, মৌলবাদ এবং তার বীভত্স পরিণতি জঙ্গি হিংসা বিষয়ে সাবধান করেছিলেন। |
প্রতিনিধি। বিশ্ব ধর্মমহাসভায় (বাঁ দিক থেকে) বীরচন্দ গাঁধী, ধর্মপাল এবং স্বামীজি। শিকাগো, ১৮৯৩ |
সেই উনিশ শতকেও যে স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগোর মঞ্চে দাঁড়িয়ে এই কথা বলে গিয়েছিলেন, এটাই বোধহয় অমোঘভাবে প্রমাণ করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের মতো রাষ্ট্র আসলে একই মৌলিক নীতির উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে, যদিও প্রত্যহ নানাবিধ চ্যালেঞ্জের বেড়া পেরিয়ে আমাদের সেই রাষ্ট্রিক আদর্শের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়। এই দুই দেশ বহুসংস্কৃতির বৈচিত্র নিয়ে গর্বিত, ব্যক্তিগত ধর্মাচরণের স্বাধীনতায় তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, হিন্দু খ্রিস্টান মুসলিম শিখ ইহুদি ও অন্য সকল ধর্মাবলম্বী মুক্ত ভাবে নিজের নিজের ধর্ম যাপন করবে, এই মতের অবলম্বী। বিবেকানন্দ সহনশীলতার উপর যতখানি গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তা বুঝিয়ে দেয় আজকের মতো সে দিনও, তাঁর জীবত্কালেও, বিষয়টি একই রকম জরুরি ছিল।
অনেক অর্থেই বিবেকানন্দ ছিলেন মার্কিন জনসাধারণের কাছে ভারতের প্রথম দূত। তিনিই ভারতের দর্শন, সংস্কৃতি ও ধর্মের সঙ্গে আমেরিকাবাসীর প্রথম বার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, দুই দেশের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ক্রমে স্থাপিত হয়েছে তার অগ্রদূত ছিলেন, বিশেষত ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ ও দর্শন বিষয়ে আমেরিকাবাসীর সচেতনতার সূচনা তাঁর সূত্রেই। আজ প্রায় প্রতিটি মার্কিন ঘরে ‘যোগাভ্যাস’-এর প্রতিপত্তি, হিন্দুত্বের একটা মোটামুটি প্রাথমিক জ্ঞান এ সব কিছুর গোড়াটা কিন্তু বিবেকানন্দের সেই একশো কুড়ি বছর আগের সফরের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসে প্রথম হিন্দু সদস্যকে যোগ দিতে দেখা গেল। এই ঘটনার সূত্রেও বিবেকানন্দের ঐতিহাসিক অবদানের কথা আমাদের মনে পড়ে, মার্কিন জনজীবনে তাঁর ধর্মোপদেশের আজও যে প্রভাব, তা যে উপেক্ষার বস্তু নয়, সেই উপলব্ধি হয়।
তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়, দর্শন-অধ্যাত্মবাদের বাইরেও আজ এই দুই দেশের মধ্যে বিজ্ঞান, চিকিত্সাশাস্ত্র, সারস্বতচর্চা, শিল্পবাণিজ্যের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, প্রাত্যহিক দেওয়া-নেওয়া, বিবেকানন্দ তা দেখলে খুবই প্রফুল্ল বোধ করতেন। কেবল শিকাগোয় নয়, সমস্ত জীবন ধরে বিবেকানন্দ আমাদের কেবলই অনুরোধ করেছেন ‘আপন হতে বাহির হয়ে’ বাইরে দাঁড়ানোর জন্য। হয়তো আজ যে ভাবে ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক নিত্যনতুন বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যে ভাবে হাজার হাজার নাগরিকের এ পার ও পার যাতায়াতে প্রতি দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে, তাতে শেষ পর্যন্ত তাঁর সেই কল্পনার একত্র-মঞ্চেই আমরা এসে দাঁড়াতে পারছি বলে মনে হয়। যেমন, আমেরিকা ও ভারতের বিজ্ঞানীরা যখন আরও অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে মিলে আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণায় নিরত হন, কিংবা হিগ্স-বোসন রহস্য আবিষ্কারে ব্রতী হন, তখন তাঁরা নিশ্চয়ই অন্য সব ভেদাভেদ তুচ্ছ করে সেই দুনিয়াটাই তৈরি করতে চান যেখানে জ্ঞানের ক্ষেত্র সকলের জন্য মুক্ত, অন্তত তুলনায় মুক্ত-তর।
তবে, আজও যে বিপুল পরিমাণ অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতিতে আমরা গ্রস্ত হয়ে থাকতে বাধ্য হই, তা দেখলে বিবেকানন্দ অবশ্যই চমকে উঠতেন। আমেরিকাতেও, ভারতেও শ্রেণি, ধর্ম, লিঙ্গ, জাতি নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে তার প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা দেওয়ার যুদ্ধ আমাদের আজও প্রতি দিনের সঙ্গী। কিন্তু আমার মনে হয়, তিনি যে পরিমাণ শক্তির আধার ছিলেন, তাতে এ সব দেখেও আশা হারিয়ে তিনি ভেঙে পড়তেন না কখনওই। বরং যারা, বিশেষ করে যে তরুণ-তরুণীরা তাঁর জীবনের লক্ষ্য ও আদর্শ মনে রেখে সমস্ত কু-শক্তির সঙ্গে অবিরাম সাহসে লড়াই করে চলেছে, তাঁদের উপর আস্থা রাখতে পারতেন বিবেকানন্দ। সেই তরুণতরুণীদের মধ্যে আছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠরত ভারতীয়রা, যাঁরা শিক্ষালাভের সঙ্গে সঙ্গে দুই দেশের মৈত্রীবন্ধনকেও জোরালো করছেন। তাদের মধ্যে আছেন অসংখ্য মার্কিন যুবকযুবতী যাঁরা ভারতে আসেন পড়াশোনা করতে, বা পর্যটক হিসেবে সুদূরের দেশটিকে চিনে নিতে, ভারতের ঐতিহ্যসমৃদ্ধ অতীত এবং সম্ভাবনাদীপ্ত ভবিষ্যত্কে বুঝে নিতে। এই নব প্রজন্ম কেবল তাদের জীবনযাপন দিয়ে কী ভাবে একুশ শতকের দুনিয়াকে নতুন করে গড়ছে, তাকে নতুন ভাবে অর্থপূর্ণ করে তুলছে, সেই সহজ সত্যটি প্রায়ই আমরা ভুলে থাকি। চল্লিশ বছরের জীবনে বিবেকানন্দ যে বিরাট পরিমাণ চিত্তশক্তি ও অর্থশক্তির পরিচয় দিয়ে গিয়েছিলেন, সেটা মনে রাখলে তারুণ্যের এই শক্তি আবার নতুন ভাবে আমাদের আশাময় করে তোলে।
সার্ধশতবর্ষপূর্তির লগ্নে আরও এক বার না হয় হিংসাদ্বেষ-বিহীন পৃথিবী গড়ার শপথ নেওয়া যাক। ভাবা যাক যে, অন্তত এইটুকু করতে বিবেকানন্দের কাছে আমরা দায়বদ্ধ। বিবেকানন্দ যদিও নিশ্চিত ভাবে মনে করিয়ে দিতেন যে না, তাঁর কাছে নয়, আমাদের নিজেদের কাছেই, এবং ভবিষ্যত্ প্রজন্মের কাছে আমাদের এই দায়! |
• টুইটার হ্যান্ডল্: @deanthompson |