শুধু ওয়াশিংটন নয়। খরচ ছাঁটাই আর চড়া হারে কর বসানো নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে রাজনৈতিক চাপানউতোরের সময় ঘুম উড়ে গিয়েছিল দিল্লিরও।
কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের এক কর্তার দাবি, “খরচ কমানো ও কর বসানোর বাধ্যবাধকতা থেকে রেহাইয়ের প্রস্তাব মার্কিন কংগ্রেসে পাশ না হওয়া অবধি উৎকণ্ঠার প্রহর গুনেছি।” তাঁর দাবি, মার্কিন অর্থনীতি খাদের কিনারা থেকে আপাতত এক পা পিছিয়ে আসায় বারাক ওবামা হাঁফ ছেড়েছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে স্বস্তির শ্বাস ফেলেছেন মনমোহন সিংহ, পি চিদম্বরমও। কারণ, আমেরিকায় সঙ্কট নতুন করে ঘোরালো হলে, ভারতের অর্থনীতিও গাড্ডায় পড়বে বলে আশঙ্কা করছিলেন তাঁরা। অবশ্য এই স্বস্তি কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে সব মহলেই।
কথা হচ্ছিল, ঘাটতি আর ধারের বোঝা কমাতে নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই রাজস্ব আদায় বাড়াতে বাধ্য থাকবে মার্কিন সরকার (১০ বছরে ৬০ হাজার কোটি ডলার)। তার জন্য চড়া হারে কর বসবে সাধারণ মানুষের উপর। বিপুল ছাঁটাই হবে সরকারি খরচেও (১০ বছরে ১ লক্ষ ২০ হাজার কোটি ডলার)। আশঙ্কা ছিল, এই ‘সাঁড়াশি আক্রমণে’ শুধু আমেরিকাতেই কাজ হারাবেন ৩৪ লক্ষ মানুষ। মন্দার মুখে ঢলে পড়বে মার্কিন অর্থনীতি। সঙ্কট গভীর হবে বাকি বিশ্বে। এই আশঙ্কাকেই কয়েক মাস ধরে ‘ফিস্কাল ক্লিফ’ নামে ডেকেছে সারা পৃথিবী।
এখনও আর্থিক সঙ্কট থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখাতে পারেনি ইউরোপ। তার উপর মার্কিন মুলুকও যদি ফের দীর্ঘমেয়াদি মন্দার ঢেউয়ে তলিয়ে গেলে সেই ধাক্কা ভারত কী ভাবে সামালাবে, তা নিয়েই বছরের শুরুর ক’দিন কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের।
এমনিতেই বেশ কিছু দিন ধরে ভারতের রফতানির হাল বেশ খারাপ। আমেরিকায় ফের মন্দা হলে, এই ক্ষেত্রে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে বলে মনে করছিলেন অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা। কারণ, ভারতের রফতানির ১১% হয় ওবামার দেশেই। আমেরিকা মুখ থুবড়ে পড়লে, মাথায় হাত পড়ত বিদেশি লগ্নি টানার ক্ষেত্রে। ভারতীয় অর্থনীতির চাকায় গতি ফেরাতে যা কেন্দ্রের অন্যতম বাজি। বিদেশি আর্থিক সংস্থাগুলির লগ্নির অভাবে তলিয়ে যেত শেয়ার বাজারও।
এই সব কারণেই মার্কিন মুলুকে বিল পাশের পর অর্থমন্ত্রী চিদম্বরমের প্রতিক্রিয়া ছিল, “ভারত-সহ সারা বিশ্বের অর্থনীতির কাছেই এটা ইতিবাচক।” বণিকসভা ফিকি-র মহাসচিব এ দিদার সিংহ-ও বলেন, “আমেরিকার উপর সারা বিশ্বের অর্থনীতি নির্ভরশীল। কাজেই সেখানে ভারসাম্য বজায় থাকলে, ভারতের জন্যও তা ভাল।’’
কিন্তু এই স্বস্তি কতখানি স্থায়ী হবে? অনেকেরই ধারণা, খরচ কমিয়ে ও আয় বাড়িয়ে মার্কিন অর্থনীতির হাল ফেরাতে টেনেটুনে মাস দুয়েক সময় পেয়েছেন ওবামা। কারণ, ফেব্রুয়ারিতে ঋণের ঊর্ধ্বসীমা বৃদ্ধির সময় ফের বেঁকে বসতে পারেন রিপাবলিকানরা। তখন ফের এক প্রস্ত দড়ি টানাটানি।
ঠিক এই কারণেই একে ‘ব্যান্ড-এইড’ লাগিয়ে ক্ষত সারানোর মতো ক্ষণস্থায়ী চিকিৎসার সঙ্গে তুলনা করেছেন অর্থনীতিবিদ বিবেক দেবরায়। আবার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসি-র অধ্যাপক পিনাকি চক্রবর্তীর বক্তব্য, “ওবামা-সরকার ঘাটতি কমাতে চায়। তাতে বেসরকারি লগ্নি বাড়লে শুধু আমেরিকার নয়, ভারতেরও লাভ। না হলে, মার খাবে ভারতের রফতানি।”
ঠিক এই সম্ভাবনা মাথায় রেখেই অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা মনে করছেন, ভারতের অর্থনীতির চাকায় গতি ফেরাতে শুধু মার্কিন অর্থনীতির দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। বরং লগ্নিকারীদের আস্থা জয় করতে হবে। তার জন্য স্বচ্ছতা আনতে হবে জমি-নীতি ও কর-ব্যবস্থায়। রূপায়িত করতে হবে সংস্কার কর্মসূচি। জোর দিতে হবে পরিকাঠামো গড়ার উপর। তবেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ টানা সম্ভব হবে। এই মতকে সমর্থন করে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জয়তী ঘোষও বলেন, “আমেরিকা বা ইউরোপের দিকে তাকিয়ে না থেকে সরকারের উচিত পরিকাঠামো ও খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোয় নজর দেওয়া।” |