সরকার পাল্টে গেলে পছন্দের আমলাও পাল্টে যায়। রাজনীতিতে এই রীতি অনেক দিনের। কিন্তু রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পরে একের পর এক অফিসারকে যে ভাবে কারণ দর্শানোর সুযোগ না দিয়েই ‘কম্পালসারি ওয়েটিং’-এ পাঠানো হচ্ছে (যার শেষ উদাহরণ অতিরিক্ত জেলাশাসক, আসানসোল), তাতে আমলাদের একাংশ শঙ্কিত। সরকারি অফিসারদের ‘পোস্টিং’ দিতে দেরি হলে যে সবেতন অপেক্ষা করানোর নিয়ম চালু আছে, তা ‘শাস্তি’ হিসেবে ব্যবহার করা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
গত বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান ও আসানসোলে সভা করে ফিরে আসার পরেই অতিরিক্ত জেলাশাসক (আসানসোল) জয়ন্তকুমার আইকতকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পদাধিকার বলে আসানসোলের পুর কমিশনার এবং এসবিএসটিসি-র ম্যানেজিং ডিরেক্টরও ছিলেন তিনি। কেন ‘কম্পালসারি ওয়েটিং’-এ তাঁকে পাঠানো হল, তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা কোনও মহল থেকেই মেলেনি। একটি সূত্রের দাবি, বর্ধমানের জেলাশাসকের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্ঘাত বেধেছিল। অন্য এক সূত্রের খবর, বর্ধমান সফরে আয়োজন নিয়ে বিরক্ত হয়েছিলেন মমতা। জয়ন্তবাবু ছিলেন তার দায়িত্বে। দুইয়ে মিলে তাঁর ঘাড়ে কোপ পড়েছে। |
মহাকরণ সূত্রের খবর, তৃণমূল সরকারের বিরাগভাজন হওয়ায় এর আগে ‘কম্পালসারি ওয়েটিং’-এ যেতে হয়েছে বেশ কিছু অফিসারকে। এর মধ্যে ক্রীড়ামন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়, ডেপুটি রেসিডেন্ট কমিশনার উল্লাস চট্টোপাধ্যায়, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতরের অধিকর্তা উদয়ন মজুমদার, উত্তর চব্বিশ পরগনার অতিরিক্ত জেলাশাসক প্রভাস বিশ্বাস, এসএসসি-র অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার বেদাঙ্গ বিশ্বাস, তথ্য অধিকর্তা উমাপদ চট্টোপাধ্যায় অন্যতম। উমাপদবাবুকে সপ্তাহখানেক আগেই সরানো হয়েছে।
কী অপরাধ জয়ন্তবাবুর? রাজ্য প্রশাসন সূত্রের খবর, অন্তত দু’টি ব্যাপারে ভুল করে ফেলেছেন তিনি। এক, আসানসোলের সভায় যে ছাত্রীদের সাইকেল দেওয়া হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছিলেন, তারা মঞ্চের সামনে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাক। কিন্তু তা হয়নি। জেলা প্রশাসনের কিছু কর্তা মমতাকে জানান, অতিরিক্ত জেলাশাসক নিরাপত্তার বাহানা তুলে তাতে বাদ সেধেছেন। দুই, কলকাতা থেকে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যাওয়া তিন সচিবের জন্য বার্নপুরে ইস্কো আবাসনে থাকার ব্যবস্থা করা হলেও তাঁরা গিয়ে দেখেন, তালা ঝুলছে। সেখানে এক মন্ত্রীরও থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। তিনিই নাকি তালা দিয়ে চলে যান। পরে আসানসোল সার্কিট হাউসে সচিবদের থাকার ব্যবস্থা করা হলেও তা তাঁদের পছন্দ হয়নি। শেষে একটি হোটেলে তাঁদের রাখা হয়। সেই ‘অব্যবস্থা’র খবরও মুখ্যমন্ত্রীর কানে গিয়েছিল।
জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, এর আগেই বেশ কিছু ব্যাপারে জয়ন্তবাবুর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা। এর মধ্যে বর্ধমানে নতুন তৈরি হওয়া দু’টি বাসস্ট্যান্ডে এসবিএসটিসি-র বাস রাখা নিয়ে সঙ্ঘাত তো ছিলই। তার উপরে, মুখ্যমন্ত্রীর পাট্টা দেওয়ার কিছু জমি তাদের বলে ইতিমধ্যে দাবি করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত কয়লা সংস্থা ইসিএল। সে দিন মমতা যে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিলান্যাস করেন, তার জমি নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। এই জমি-সমস্যার দায় বর্তেছে অতিরিক্ত জেলাশাসকের ঘাড়েই। যদিও জেলাশাসক এ নিয়ে কথা বলতে চাননি। যোগাযোগ করা যায়নি জয়ন্তবাবুর সঙ্গেও।
আমলারা মুখ না খুলতে চাইলেও রাজনৈতিক মহল এ নিয়ে সরব হয়েছে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “যতটুকু জেনেছি, মুখ্যমন্ত্রীর সভায় যাতে বিশৃঙ্খলা না হয় তাই ওই অফিসার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে ডেকে বলতে পারতেন! তাই বলে একেবারে বসিয়ে দেবেন?” সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদারের বক্তব্য, “খোঁজ নিয়ে জেনেছি, উনি সৎ এবং দক্ষ। একটা উপলক্ষ খাড়া করে ওঁকে সরিয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছু বলিষ্ঠ পদক্ষেপ করাতেই উনি প্রশাসনের বিরাগভাজন হয়েছেন।” |