আপাত ভাবে তাঁর কোনও শারীরিক সমস্যা ছিল না। তা সত্ত্বেও কিছুতেই মা হতে পারছিলেন না ব্যারাকপুরের গৃহবধূ সুতপা কুণ্ডু। অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছিলেন বারবার। কিন্তু কিছুতেই শেষ পর্যন্ত সন্তান জীবিত থাকছিল না। হয় গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে নয়তো সাত-সাড়ে সাত মাসে তাদের মৃত্যু হচ্ছিল গর্ভেই। দীর্ঘ ১৪ বছরের বিবাহিত জীবনে তাই মা হওয়ার স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে গিয়েছিল সুতপাদেবীর।
শুরু সেই ১৯৯৯-এ। আড়াই মাসেই গর্ভপাত হয়ে যায় তাঁর। ২০০১-এ দ্বিতীয় বার। সে বার সাড়ে সাত মাসে সন্তানের জন্ম হলেও শিশুটি মারা যায় কিছুক্ষণ পরেই। তৃতীয় বার ২০০২ সালে। সে বারও সাড়ে সাত মাসে গর্ভেই মারা যায় শিশুটি। এই রকম ভাবে সাত বার গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট হয়ে যায় সুতপাদেবীর। শেষ বার ছিল ২০০৯-এ। সে বারও গর্ভেই মৃত্যু হয় সন্তানের। কিন্তু মনের জোর নিয়ে অষ্টম বার গর্ভধারণ করে সম্প্রতি সুস্থ পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছেন সুতপাদেবী। নাম রেখেছেন হৃষীকেশ। অত্যাধুনিক চিকিৎসা সত্ত্বেও একাধিক বার গর্ভপাত চিকিৎসকদের কাছে উদ্বেগের কারণ। স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ গৌতম খাস্তগীর বলেন, “আমার কাছে অনেকে আসেন যাঁদের একাধিক বার গর্ভপাত হয়েছে। সুতপাদেবীর ক্ষেত্রে যত বার গর্ভপাত হয়েছে, সেটা একটু বিরল। তাই এই ধরনের রোগিণীদের ক্ষেত্রে আমাদের অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হয়। এটা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। অনেক সময় এই চ্যালেঞ্জ আমরা সফল ভাবে উতরে যেতে পারি। অনেক সময় হয়তো তা হয় না।” |
যে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সুতপাদেবী অষ্টমবার গর্ভধারণ করে অবশেষে মা হতে পেরেছেন, সেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায় বলে, “সপ্তমবারও যখন সুতপাদেবীর সন্তান বাঁচল না, তখন ওঁরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনে ক্রোমোজোম পরীক্ষা করান। কিন্তু সেখানে কোনও গণ্ডগোল ছিল না। ওঁরা বাচ্চা দত্তক নেবেন বলে প্রায় ঠিকও করে ফেলেছিলেন। তবুও শেষ চেষ্টা করবেন বলে ওঁরা মনস্থ করেন। অষ্টম বার চেষ্টার আগে তাই থেকেই ওঁর নানা রকম পরীক্ষা ও চিকিৎসা শুরু করে দিই।”
যে সব কারণে বারবার গর্ভপাত হতে পারে, তার মধ্যে অন্যতম হল রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার প্রবণতা (ক্লটিং ডিসঅর্ডার)। এই সমস্যা থাকলে গর্ভস্থ সন্তানের শরীরের সূক্ষ্ম রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে ও মৃত্যু হতে পারে। কয়েকটি পরীক্ষার মাধ্যমে তা জানা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সুতপাদেবীকে পরীক্ষা করে তেমন কিছু পাওয়া না গেলেও সেটির আগাম চিকিৎসা করেন মল্লিনাথবাবু। তাঁর কথায়, “অনেক সময় পরীক্ষায় সমস্যাটি বোঝা না-ও যেতে পারে। তাই আর ঝুঁকি নিইনি।”
আরও যে সব কারণে বার বার গর্ভস্থ সন্তানের মৃত্যু হতে পারে, সেগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল মায়ের ডায়াবিটিস, যৌনাঙ্গের সংক্রমণ, লিভারের সমস্যা ইত্যাদি। সুতপাদেবী গর্ভধারণ করতেই সেগুলির জন্য সবরকম চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া হয়। ডায়াবিটিস প্রথমে পাওয়া না গেলেও তার চিকিৎসা করা হয় এবং গর্ভাবস্থার সাত মাসে দেখা যায় সুতপাদেবীর ডায়াবিটিস রয়েছে। কিন্তু ততদিনে তিনি চিকিৎসার আওতায়। তার আগে চার মাসে ভ্রূণের ক্রোমোজোম পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া হয়েছে তার কোনও জন্মগত ত্রূটি আছে কি না। সে দিক থেকেও নিশ্চিন্ত হয়ে যায় কুণ্ডু পরিবার।
সব দিক নিশ্চিত করার পরে অবশেষে প্রথম বার পূর্ণ সময় তাঁর গর্ভে থাকতে পারে সুতপাদেবীর অষ্টম সন্তান। নির্বিঘ্নেই জন্ম হয় তার। |