|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
জাতিসত্তার গভীর বিশ্লেষণ |
শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় |
স্বজাতি স্বদেশের খোঁজে, সেমন্তী ঘোষ। দে’জ পাবলিশিং, ১৫০.০০ |
মাস্টারমশাইয়ের পক্ষে ছাত্রীর লেখা বইয়ের আলোচনা করতে যাওয়ার মধ্যে কিছুটা বিপদ আছে। বেশি প্রশংসা করলে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠতে পারে। সেই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে লিখছি যে স্বজাতি স্বদেশের খোঁজে ভারত ও বাংলার ইতিহাসের কতগুলি অতিপরিচিত বিষয় সম্পর্কে আবার নতুন করে ভাবনাচিন্তা করতে আমাকে বাধ্য করল। এই বইয়ের মূল উপপাদ্য বিষয় জাতীয়তাবাদ: অতি পরিচিত এবং বহু-আলোচিত বিষয়। বইয়ের শিরোনাম দেখলে প্রথমে হয়তো মনে হতে পারে, এই বিষয়ের ওপর আরও একটা বইয়ের কী দরকার ছিল! কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে ইতিহাস তো শুধুমাত্র ঘটনার সমাবেশ নয়। ঘটনাগুলির অর্থ ও তাত্পর্য নির্ভর করে ঐতিহাসিকের ব্যাখ্যার ওপরই। আর এই ব্যাখ্যা সমানে পাল্টে চলে, নতুন প্রজন্মের ঐতিহাসিকরা তাঁদের নিজস্ব বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে নতুন নতুন প্রশ্ন তোলেন, অভিনব গবেষণা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন, ইতিহাসের নতুন নতুন উপাদান ব্যবহার করেন। ফলে যে ঘটনাগুলিকে এক দিন মনে হয়েছিল বেশ সহজ-সরল, তার মধ্যেই চোখে পড়তে থাকে অনেক রকম জটিলতা। ডেভিড ক্যানাডাইন তাঁর মেকিং হিস্ট্রি: নাও অ্যান্ড দেন (২০০৮) বইতে ঐতিহাসিকদের সাবধান করে দিয়েছিলেন যে তাঁরা যেন ইতিহাসকে শুধুমাত্র কতগুলি সরলীকৃত দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের মধ্যে না দেখে তার অন্তর্নিহিত স্তরবিন্যাস, প্রবহমানতা ও সূক্ষ্ম স্তরগুলির অনুসন্ধান করেন।
ভারতের জাতীয়তাবাদের আলোচনা অনেক দিন পর্যন্ত তেমন কতগুলি দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের ধারণার মধ্যেই আবদ্ধ ছিল, যেমন জাতীয়তাবাদ বনাম বিচ্ছিন্নতাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম সাম্প্রদায়িকতা, দেশ বনাম আঞ্চলিকতা। কেউ যদি এটা হন, তবে অন্যটা হতে পারবেন না। সাম্প্রতিক কালের ঐতিহাসিকরা এই সরলরৈখিক ছবিটিকে ভেঙে তার অন্তর্নিহিত জটিলতাগুলির সন্ধান করছেন। সেমন্তীর বই ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯৪৭-এর দেশভাগ— এই সময়সীমার মধ্যে বাংলায় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের এমনই এক বহুমাত্রিক ছবি উপহার দেয়। |
|
বাঙালির পণ বাঙালির আশা। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সভায় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়,
৩০ আশ্বিন ১৩১২ বঙ্গাব্দ। ছবি: হেমেন্দ্রমোহন বসু |
জাতীয়তাবাদের ইতিহাসকে সাধারণত আমরা জাতিরাষ্ট্র গঠনের পূর্বকাহিনি হিসেবেই দেখি। মনে করি, ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে সংগ্রামের মধ্যে ভারতীয়রা তাদের জাতিসত্তা আবিষ্কার করে, যার পরিণতি ঘটে ভারতীয় জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মধ্যে। ঠিক তেমনই আমরা ভাবি, মুসলমান সম্প্রদায় সেই সময় আবিষ্কার করছিলেন তাঁদের মুসলিম সত্তা, যার অবশ্যম্ভাবী প্রতিফলন ঘটেছিল দেশবিভাগ ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায়। এই সহজ-সরল গল্পটির ভেতরে যে কত রকম জটিলতা ছিল, সেমন্তীর বই তা নিয়ে আলোচনা করে। এক দিকে যেমন ‘ঐক্য’ গঠনের আন্দোলন চলছিল, আর এক দিকে তেমনই ‘স্বাতন্ত্র্য’ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসও অব্যাহত ছিল। এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক যে সব সময় সংঘাতপূর্ণ ছিল, তা’ও নয় অনেক ক্ষেত্রেই এটি ছিল বোঝাপড়ার সম্পর্ক। অর্থাত্ ভারতীয় হলেই যে বাঙালিয়ানার উপরে তাকে বসাতে হবে, তা নয়। আবার বাংলার স্বার্থ ও সমস্যার কথা জোর দিয়ে বলা মানেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার করা নয়। তেমনই অন্য দিকে বাঙালি মুসলমান-মাত্রই সবাই যে নিজেদের শুধু ‘মুসলমান’ বলে মনে করছিলেন এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা-ও নয়। অনেকেই তাঁদের বাঙালিয়ানাকে বিসর্জন দেননি। হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের মাধ্যমে বাংলার প্রগতির কথা অনেকেই ভেবেছেন। সমকালীন পত্রপত্রিকা ও সাহিত্য থেকে এমন বহু উদাহরণ সেমন্তী আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন।
আত্মসত্তা নির্মাণের ক্ষেত্রে যেমন চিন্তার বিভিন্নতা ছিল, ঠিক তেমনই জটিলতা দেখা যায় তার প্রয়োগের ক্ষেত্রেও, অর্থাত্ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পরিসরেও। সেখানে এক দিকে ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মতো নেতা, যিনি সর্বভারতীয় কংগ্রেসি আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্বে থেকেও বাংলার স্বতন্ত্র সত্তার কথা বিস্মৃত হননি এবং সেখানে স্থাপন করেছিলেন হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের এক অভিনব উদাহরণ: ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’। তবে গণ আন্দোলনের নেতা হিসেবে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে তিনি ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বলেই দেখেছিলেন, সেখানে তাঁর মতপার্থক্য ঘটেছিল এই যুগের আর এক চিন্তানায়ক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে সক্রিয় ভাবে থাকলেও ক্রমশ প্রত্যক্ষ রাজনীতির আসর থেকে নিজেকে সরিয়ে আনেন রবীন্দ্রনাথ। এবং ক্রমশ পশ্চিমি ধাঁচের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের এক কড়া সমালোচক হয়ে ওঠেন তিনি। নিজের কর্মজগত্কে তিনি রাষ্ট্র ও ক্ষমতার লড়াইয়ের চৌহদ্দির বাইরে নিয়ে গিয়ে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় পল্লি উন্নয়নের পথে সঞ্চালিত করেন। এই সমাজ-উন্নয়নমূলক জাতিগঠনের কাজকে কি আমরা রাজনীতি বলব? সেমন্তীর যুক্তিতে, কেন নয়? কারণ রবীন্দ্রনাথ তো রাজনীতির সংজ্ঞাটাকেই পাল্টে দিতে চাইছিলেন। এবং এখানে জননেতা চিত্তরঞ্জনও ছিলেন তাঁর সঙ্গে একমত। তিনিও মনে করতেন, রাজনীতির একটা সামাজিক দিক থাকা দরকার। এই ভাবেই জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের বিভিন্ন ধারার মধ্যে প্রতিনিয়ত চলছিল সংঘাত ও মিলন। একে অন্যের ‘অপর’, এই দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের মধ্যে এই ইতিহাসকে বুঝতে গেলে ভুল হতে পারে। যেমন, ফজলুল হকের মতো নেতা, যিনি ১৯৩৮-এ মুসলিম লিগে যোগ দেন এবং ১৯৪০-এ লাহৌরে ‘পাকিস্তান’ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন, তিনিও কিন্তু একই সঙ্গে বাংলায় হিন্দু-মুসলমান ঐক্য এবং দরিদ্র চাষির স্বার্থ রক্ষার কথা বলেছিলেন জোরের সঙ্গে। সাদা-কালো রঙে ইতিহাসকে রাঙাতে গিয়েই সম্ভবত পাকাপাকি ভাবে ভাগাভাগিটা করে ফেলেছি আমরা।
সেমন্তীর বই বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের বই নয়, বরং বলা চলে রাজনৈতিক চিন্তার ইতিহাস। এই ধরনের ইতিহাস এ যাবত্ খুব কমই লেখা হয়েছে। সে দিক দিয়ে এটি একটি নতুন পথের দিশারি। বইটি তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বের ছ’টি অধ্যায়ের মূল উপপাদ্য বিষয় বাঙালির আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের ইতিহাস। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বের প্রবন্ধগুলি খানিকটা আলগা ভাবে এই বইতে সংযোজিত হয়েছে। এই পূর্বপ্রকাশিত প্রবন্ধগুলি বইয়ের প্রয়োজনে আবার নতুন করে লেখা হলে হয়তো বইয়ের বাঁধুনিটা আরও জোরাল হত। কিন্তু এই সামান্য দুর্বলতা সত্ত্বেও বইটি বাংলার ইতিহাসের সব পাঠককে আবার নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। |
|
|
|
|
|