ব্যাগ গুছিয়ে... চিরস্মৃতির বারাণসী

“দেখিয়ে, উয়ো হ্যায় মুন্সি ঘাট। উয়াহাঁ পর হি বঙ্গালি ফিল্ম জয়বাবা ফেলুনাথ কা শ্যুটিং হুয়া থা।”
হ্যাঁ, ওই তো বেশ চেনা চেনা লাগছে। আশপাশে কোথাও মগনলাল মেঘরাজের বজরাটা চোখে পড়বে নিশ্চয়ই। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, নাঃ! সেটা নেই। তবে সঙ্গী হয়েছে আরও অগুনতি নৌকা। ছোট-বড় নানা চেহারার। কোনওটায় মাঝি দাঁড় বাইছে, কোনওটা আবার যন্ত্রচালিত, এগিয়ে চলেছে ভটভট করে। ঘাটের গায়েই মাথা তুলে রয়েছে পাথুরে ইমারত। মছলিবাবার আস্তানাটা এখানেই কোথাও ছিল হয়তো!
সেই বারাণসী! নৌকা থেকেই দেখা যাচ্ছে, সকালের নতুন সূর্য প্রথম আলো ফেলেছে ঘাটের হলদে-কমলা পাথরে। তাগড়াই চেহারার জনাকয়েক তেল মেখে ডন-বৈঠক সেরে নিচ্ছেন ওখানেই। ঠাণ্ডাও ভালই পড়েছে। সকালের গঙ্গার হাওয়াটা তাই সোয়েটার-টুপি ভেদ করে হাড়ে গিয়ে শিরশিরানি লাগাচ্ছে। তার মধ্যেই পুণ্যিলাভের আশায় ঝুপঝাপ গঙ্গায় ডুব দেওয়া চলছে। ‘ঠণ্ডা পানি কো গরম কর দো বাবা ভোলেনাথ’ শীত কাটাতে গান ধরেছেন কেউ কেউ।
বারাণসীতে নৌকায় ঘাট-সফর। ঘাট তো আর একটা-দু’টো নয়। সিন্ধিয়া, দত্তাত্রেয়, মণিকর্ণিকা, ললিতা, মানমন্দির, দশাশ্বমেধ, চৌষট্টি, রানা, অহল্যা বাঈ, পান্ধে, রাজা, মুন্সি, পঞ্চগঙ্গা, মানসরোবর, কেদার, হরিশচন্দ্র, শিবালা, তুলসী, অসি ঘাট নাম করতে করতেই বেলা ফুরোবে। এক-একটি ঘাটের এক-এক রকম চরিত্র। এই যেমন ধরুন আপনি হয়তো চুপচাপ বসে আছেন দশাশ্বমেধ ঘাটে। সূর্য ধীরে ধীরে মাথার উপরে উঠেছে। দশাশ্বমেধের সার সার রঙিন ছাতার তলায় থিকথিকে ভিড়। কোথাও ভজন চলছে তারস্বরে, কোথাও ভক্তকুলকে ধর্মকথা শোনাচ্ছেন কোনও কথক।
তার মধ্যেই হঠাৎ ক্যামেরার সামনে পোজ দেওয়ার জন্য আপনাকে অনুরোধ করতে পারে ইতালীয় অথবা ফরাসি সুন্দরী। অদ্ভুত বৈপরীত্য! এক দিকে দল বেঁধে নৌকাভ্রমণের জন্য প্রস্তুত বিশ্বনাগরিকেরা, অন্য দিকে আবার ছাই মেখে, মাথায় গেরুয়া পাগড়ি বেঁধে, রুদ্রাক্ষের মালা গলায় সক্কাল সক্কাল তৈরি সাধুসন্তেরা।
মানমন্দির বা মুন্সি ঘাট তুলনায় নিরিবিলি। তবুও সেখানে বসে ডিঙি-নৌকার আনাগোনা দেখতে দেখতে দিব্যি দিন কেটে যায়। বেলা বাড়ে। আর ঘাটগুলোও তার চরিত্র বদলায়। দুপুরের বারাণসী একটু স্তিমিত যেন। দশাশ্বমেধে তখনও চলছে ভজন। মণিকর্ণিকায় চিতাও জ্বলছে। হ্যাঁ! মণিকর্ণিকায় মৃতদেহের সৎকার চলতে থাকে দিনভর। সেখানে ছবি তোলাও মানা। বলছিলাম দুপুরের ঘাটচিত্রের কথা। তখন নৌকাসফরে একটু যেন ভাটা পড়ে। খালি নৌকাগুলো সারে সারে ভিড়িয়ে দেওয়া হয় ঘাটজুড়ে। বিকেল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোনও কোনও ঘাট চত্বরে জমে ওঠে ক্রিকেট। আনাগোনা বাড়ে ফুলবিক্রেতাদের। আবার শুরু হয় নৌকাবিহার। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রদীপ বিক্রি করে যায়। নৌকাবিহারের ফাঁকে চলে গঙ্গায় ‘দিয়া’ ভাসানো। আর দিনের আলো পড়ে এলে জলের ঢেউয়ে সেই ‘দিয়া’র টিমটিমে আলোগুলো দেখতে দিব্যি লাগে। এর মধ্যেই হয়ে যায় কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা। নৌকার মাঝির কাছ থেকে কৈবর্তদানের গল্প শুনতে শুনতেই হঠাৎ চোখে পড়ে, কাপড়ে মোড়া ছোট্ট একটি শবদেহ জলে ভাসতে ভাসতে নৌকার কোণায় এসে লাগল। মাঝির গল্প চলতে থাকে, খুব অল্পবয়সী কেউ মারা গেলে তাদের এ ভাবেই গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আর ভাসিয়ে দেওয়া হয় সর্পাঘাতে মৃতদের। ধর্মকথার কত বিচিত্র নিয়ম আর খুঁটিনাটি, মাঝির গল্প চলতে থাকে।
সন্ধ্যা নামে। দশাশ্বমেধ ঘাটের সন্ধ্যারতি দেখার জন্য সারে সারে নৌকা ভিড় করে ঘাটের সামনে। প্রত্যেকটি নৌকাতেই গিজগিজে ভিড়। পুরনো আর নতুন, দুই দশাশ্বমেধেই তখন আলোর মালায় সেজে ওঠে রঙিন ছাতাগুলো। তার নীচে ভজনের সঙ্গে শুরু হয় নয়নাভিরাম সন্ধ্যারতি, পঞ্চপ্রদীপ দিয়ে, চামর দিয়ে নাচের ছন্দে। প্রতি সন্ধ্যায় এই আরতি না দেখলে বারাণসীভ্রমণ সম্পূর্ণ হয় না।
সন্ধ্যারতির পরেই শীতের মরসুমে উপরি পাওনা হয়ে গেল দশাশ্বমেধ ঘাটের পাশেই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ও নৃত্যের অনুষ্ঠান ‘গঙ্গা মহোৎসব’। প্রতি বছরই হয় এই ‘গঙ্গা মহোৎসব’। এই উৎসবে জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক, অনেক শিল্পীকেই শোনার বা দেখার সুযোগ হয় বারাণসীবাসীর, সেই সঙ্গে পর্যটকদেরও। বারাণসী তো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেরও শহর। এই শহরের ধুলোয় জড়িয়ে রয়েছে কতশত পণ্ডিত-উস্তাদ অথবা খানদানি বাঈজিদের পায়ের ছাপ। এখনও কান পাতলে শোনা যায় বিশুদ্ধ দরবারি কানাড়ার আলাপ অথবা সেতারের মূর্ছনা। সে সুরের মেজাজই আলাদা।
এত ক্ষণ তো হল ঘাটের গল্প। এ বার শহরের মধ্যে ঢুকি। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর শুরুর দিকের ওই দৃশ্যটা মনে আছে তো? রিকশায় চড়ে বারাণসী শহরে ঢুকছে ফেলুদা-তোপসে আর জটায়ু। তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর মন্দির দেখতে দেখতে চটপট প্রণাম সেরে নিচ্ছেন জটায়ু। মন্দিরের শহর বারাণসী। সুবিখ্যাত বিশ্বনাথ মন্দির তো রয়েছেই। সঙ্গে তুলসী মানস মন্দির, সঙ্কটমোচন মন্দির, দুর্গামন্দির, ভারতমাতা মন্দির এবং প্রত্যেক ঘাটে আরও অসংখ্য মন্দির। এ ছাড়াও বারাণসী শহরের অগুনতি গলির মধ্যে মিলে যেতে পারে আরও কতশত দেবদেবীর মন্দির। বারাণসীর বিখ্যাত গলির মাহাত্ম্যও যে কম নয়! ফেলুদার সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে তোপসের শুধু নয়, প্রায় সব বাঙালিরই সে অভিজ্ঞতা হয়েছে। নাম জানা বা না জানা এ রকম হাজারো গলির মধ্যে কত্তো দোকান! কোনওটা জামাকাপড়ের, কোনওটা প্যাঁড়ার বা রাবড়ির। হোটেল থেকে জেনে নিয়েছিলাম, বিশ্বনাথের গলির পাগলা সর্দারের রাবড়ির দারুণ নাম-ডাক বাঙালি পর্যটকদের কাছে। খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছনো গেল। আহা রাবড়ির সে কী স্বাদ! ঠিক যেন অমৃত। মনের মধ্যে শুধু একটা আফশোস খচখচ করছিল, সময়টা বড্ড কম হয়ে গেল। আসলে বারাণসী ভাল করে ঘুরতে গেলে ঠিক কতটা সময় যে হাতে নিয়ে যাওয়া উচিত, বোঝা মুশকিল। শুধু তো ঘাট আর গলিই নয়, বারাণসী ঘুরতে গেলে দেখে নেওয়া উচিত বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, রামনগর দুর্গ, সারনাথ, বিন্ধ্যাচল আর চূনার দুর্গও। সারনাথের মিউজিয়াম, বৌদ্ধমন্দির, চৌখণ্ডী স্তূপ, ধামেক স্তূপ, ধর্মরাজিকা স্তূপ এবং বৌদ্ধ ধর্মের নানা নিদর্শন, বিন্ধ্যাচলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পুরাণগল্প, আর চূনার-রামনগরের দুর্গের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ইতিহাসও যথেষ্ট উপভোগ্য।
মন্দিরের শহর, গলির শহর, ঘাটের শহর কত নামে চেনা যায় বারাণসীকে! এর পুরনো গলির বাঁকে, ঘাটের সিঁড়িতে, মন্দিরের গায়ে লেগে রয়েছে ফেলে আসা সময়ের গল্প। সেই গল্প প্রাচীন ঐতিহ্যের, দেশজ সংস্কৃতির। বেড়ানো ফুরোলেও তাই ফুরোয় না স্মৃতির পথে হাঁটা। বারাণসীর দিনগুলো মনের ক্যানভাসে জ্বলজ্বল করে।

কী ভাবে যাবেন
হাওড়া, শিয়ালদহ ও কলকাতা স্টেশন থেকে বিভিন্ন সময়ে বারাণসী যাওয়ার অনেক
ট্রেন রয়েছে। পৌঁছনো যায় বিমানপথেও। এ ছাড়া, মোগলসরাই হয়েও যাওয়া যায় বারাণসী।
কোথায় থাকবেন
বারাণসীতে সরকারি ও বেসরকারি, দু’রকমেরই থাকার জায়গা রয়েছে। বিভিন্ন ঘাটের উপরেও অনেক
বেসরকারি গেস্ট হাউস রয়েছে, তবে সেগুলোর ভাড়া তুলনায় একটু বেশি। সব সময়েই
দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড় থাকে, তাই আগে থেকে বুক করে যাওয়া ভাল।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.